
.
সকাল থেকেই মিতুর মনে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি- অমর একুশে! তার স্কুলের শিক্ষকরা বলেছেন, আজ সবাই শহীদ মিনারে যাবে, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবে। সাদা-কালো পোশাক পরতে বলেছে স্যার, আর যার যার বাসা থেকে ফুল নিয়ে যেতে বলেছে। মিতুর মনে পড়ল, বাবা একদিন তাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের বাংলা ভাষার জন্য অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ গর্ব করে বাংলায় কথা বলতে পারি।’ বাবার বলা গল্প মনে পড়তেই মিতুর বুকের ভেতরটা কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠল। সে ভাবল, ‘আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাব, শহীদ মিনারে ফুল দেব!’
কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেল! ফুল কোথায় পাবে? মা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। মিতু ছোটাছুটি করে গিয়ে বলল, ‘মা, আমার তো কোনো ফুল নেই! শহীদ মিনারে আমি কী দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব?’
মা মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আমাদের ছোট্ট বাগানে তো ফুল ফুটেছে! চলো, আমরা একসঙ্গে ফুল তুলে তোড়া বানাই।’
মা-মেয়ে বাগানে গেল। সেখানে ফুটে থাকা লাল গোলাপ, গাঁদা আর শিউলি ফুল সাবধানে তুলে মা সুন্দর করে গেঁথে দিলেন। মিতু খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল ফুলের তোড়ার দিকে, মনে হলো এটাই তার গর্বের প্রতীক। মা তার চুল আঁচড়ে সুন্দর করে বাঁধলেন, খোঁপায় একটি সাদা ফিতা বেঁধে দিলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে মিতুর মনে হলো, আজ সে সত্যিকারের একজন বীরের উত্তরসূরি!
স্কুলের মাঠে সবাই জড়ো হয়েছে। মেয়েরা সাদা-কালো শাড়ি পরেছে, ছেলেরা পাঞ্জাবি-পাজামা। শিক্ষক স্যার বললেন, শহীদ মিনারে যাওয়ার আগে আমরা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি গাইব।
সকলের কণ্ঠ একসঙ্গে মিললÑ
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?’
মিতুর গলা ভারী হয়ে এল। সে যেন বুঝতে পারছে, এই গান শুধু একটা গান নয়, এটি ভালোবাসা, এটি শ্রদ্ধা, এটি আত্মত্যাগের প্রতীক।
এরপর সবাই সারিবদ্ধ হয়ে শহীদ মিনারের দিকে রওনা দিল। পথে যেতে যেতে মিতু খেয়াল করল, রাস্তার ধারে দেয়ালজুড়ে বড় বড় অক্ষরে লেখাÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’ ছোট ছোট কাগজের তৈরি জাতীয় পতাকা বিক্রি হচ্ছে, দোকানগুলোর সামনে বাংলা ভাষার পোস্টার লাগানো।
শহীদ মিনারে পৌঁছে একে একে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাল। মিতু ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গিয়ে তার ছোট্ট তোড়াটি বেদিতে রেখে দিল। তার মনে হলো, এ ফুলগুলো যেন ভাষা শহীদদের আত্মায় প্রশান্তি এনে দেবে।
স্কুলে ফিরে স্যার সবাইকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শোনালেন। তিনি বললেন, ‘ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের পরিচয়, আমাদের সংস্কৃতি। আমরা যদি নিজেদের ভাষাকে ভালোবাসি, তবে সেটাকে সম্মান করতে হবে, শুদ্ধভাবে লিখতে ও বলতে হবে।’
মিতুর মনে খুব ভালো লাগল। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ‘আমি সবসময় বাংলায় শুদ্ধভাবে কথা বলব, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসব।
বিকেলে বাসায় ফিরে বাবা যখন জানতে চাইলেন, ‘আজ তোমার কেমন লাগল?’
মিতু উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘আমি আজ ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছি, তাদের জন্য ফুল দিয়েছি। আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, আমি বাংলাকে কখনও ভুলব না, সবসময় শুদ্ধভাবে বলব ও লিখব!’
বাবা মৃদু হাসলেন, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সেটাই তো আসল শিক্ষা, মা! একুশ মানে শুধু শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নয়, বরং বাংলা ভাষাকে সম্মান করা, ভালোবাসা, আর অন্যকে ভালোবাসতে শেখানো।’ মিতু বুঝতে পারল, একুশ মানে শুধু একটি দিনের উৎসব নয়, এটি বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করার দিন।