ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১

পাগলা গারদ নয়

মানসিক হাসপাতাল

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মানসিক হাসপাতাল

.

পাবনা জেলার ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা আকারে সমৃদ্ধ। এ জেলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার পথে। কিন্তু সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নে মানসিক হাসপাতাল বাংলাদেশ এমনকি বিশ্বদরবারে সমধিক পরিচিত। তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির ফলে মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায়ও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। পাবনা শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মানসিক হাসপাতালের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। পুলিশ লাইন মোড় থেকে রূপকথা রোড দিয়ে পৈলানপুর, লাইব্রেরি বাজার, চাদমাড়ী মোড় ও কাশিপুরের পরেই পাবনা মানসিক হাসপাতালে যাওয়া যায়। আঙিনায় এসে দাঁড়ালে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। গাছগাছালির ছায়াস্নিগ্ধ সে কী রূপের শোভা। সুনীল আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে গাছগুলো মৃদু দুলছে শাখা মেলে। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘হৃদয় আমার সুন্দর তব পায়/বকুলের মতো ঝরিয়া মরিতে চায়। তাইতো প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে মানসিক রোগী ভর্তি করাতে আসেন অথবা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন অনেক মানুষ।
পাবনা মানসিক হাসপাতাল বাংলাদেশের একমাত্র মানসিক চিকিৎসা হাসপাতাল। মানসিক প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত স্থান। মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, অসুস্থ অথবা আহতকে ওষুধ ও শল্যচিকিৎসা এবং যথাযথ সেবাশুশ্রƒষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এটি।
বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে এই সংস্থা বার্ষিক অনুদান পায়। এ ছাড়া এটি দুগ্ধখামার, কৃষি খামারসহ কয়েকটি প্রকল্পও পরিচালনা করে। এসব কার্যক্রম থেকে অর্জিত অর্থ রোগীদের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকেও সংস্থাটি অনুদান পায়।
পাবনা মানসিক হাসপাতালে সরকার অনুমোদিত একটি জনকল্যাণ সংস্থা রয়েছে। রোগীরা সুস্থ হওয়ার পর তাদের নিজ বাড়িতে পৌঁছানোর খরচ এই সংস্থা বহন করে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্রও এই সংস্থা সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়াও হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সক্ষম রোগীদের চাকরি বা কাজের ব্যবস্থাও এ সংস্থাটিই করে।
রোগীদের কক্ষে গান শোনার জন্য প্রতিটি কক্ষে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে টেলিভিশন দেখার সুবিধা। এ ছাড়া হাসপাতালের চারপাশ নজরদারিতে রাখার জন্য ১০৭টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। লোডশেডিংয়ের সময় হাসপাতাল যাতে অন্ধকারে না থাকে, সে জন্য ৪৮টি সোলার বাতি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দুটি করে সোলার লাইট লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রোগীদের জন্য একটি লাইব্রেরি তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। নারী রোগীদের সুন্দর অবকাশ কাটানোর জন্য একটি ছোট্ট পার্ক ও হ্যান্ডবল খেলার জন্য একটি কোর্ট রয়েছে। তা ছাড়া ইনডোর রোগীদের হাতের কাজ শেখানো হয়, নিয়মিত পত্রিকা পড়তে দেওয়া হয়। মানুষের দেহ মন একে অপরের পরিপূরক। দেহের স্বাস্থ্যের সুস্থতার সঙ্গে মনের স্বাস্থ্যের সুস্থতা ও অপরিহার্য। দেহে রোগ হলে মনে প্রভাব রাখে তেমনি মনে রোগ হলে দেহকেও প্রভাবিত করে। তবে দেহের চিকিৎসায় অনেক হাসপাতাল থাকলেও দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে মনের চিকিৎসায় বিশেষায়িত একমাত্র হাসপাতাল হচ্ছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল। দেশে মানসিক রোগী যেভাবে বেড়েছে সেভাবে চিকিৎসা সেবা বাড়েনি। দেশের মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই মানসিক রোগীরা সারাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ছুটে এলেও ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে চিকিৎসায় মারাত্মক সংকট চলছে। বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি ২০০ শয্যার জনবল দিয়ে ৫০০ শয্যার সেবা চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালটিতে ডাক্তারসহ লোকবলের অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, জরাজীর্ণ ভবন, বাজেট বরাদ্দের স্বল্পতা, দালালের উপদ্রবের পাশাপাশি দুর্নীতি অনিয়মে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
দেশভাগের আগে এ অঞ্চলের মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় ভারতের (সাবেক বিহার) ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচি মানসিক হাসপাতালে যেতে হতো। ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের পাশে হিমায়েতপুর ইউনিয়নে তৎকালীন শীতলাই জমিদারবাড়িতে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাবনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী পাবনার মানসিক হাসপাতালের ৬০ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে হেমায়েতপুরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আশ্রমের সঙ্গে ঠাকুরের ১১১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে ১১১ দশমিক ২৫ একর জমিতে নির্মাণ শেষ করা হয়। হাসপাতালটিতে ১৫০ শয্যা পরে বাড়িয়ে ২০০ করা হয় হয়।
হাসপাতালের ৩০ একর জমি পাবনা মেডিক্যাল কলেজকে দেওয়া হলে এখানেই মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়। এরপর ৪০০ ও ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।  হাসপাতালের ১৮টি ওয়ার্ডে মধে ১৩টি পুরুষ আর ৫টি নারী ওয়ার্ড। পুরুষের মধ্যে দুটি পেয়িং, একটি মাদকাসক্ত রোগী অন্যটি সাধারণ বিভাগ। মহিলা ওয়ার্ডের ৪টি বিনামূল্যের সাধারণ ও ১টি পেয়িং ওয়ার্ড। মোট শয্যার ৩৫০টি বিনামূল্যের ১৫০টি পেয়িং। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে বহির্বিভাগ, প্রশাসনিক ভবন, ওষুধ ও মালামাল সংরক্ষণের ভবন, রান্নাঘর, ধোপাঘর, বিনোদন বিভাগ, সিনেমা হল, কম্পিউটার রুম, কুটির শিল্প ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন মিলিয়ে ৫৩টি ভবন রয়েছে। এখানে  অন্তর্বিভাগ, বহির্বিভাগ ও বিনোদন বিভাগের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। অন্তর্বিভাগে ৩৫০ পুরুষ ও ১০০ নারী চিকিৎসা নিতে পারেন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। হাসপাতাল ভবনের অধিকাংশ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
 মানসিক হাসপাতালে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার ও মাদকাসক্তি এ ৩ ধরনের রোগী ভর্তি করা হয়। আউটডোরে সব ধরনের রোগী দেখা হলেও ইনডোরে রোগী ভর্তি করানো হয়। প্রথমে মানসিক অসুস্থ রোগীকে ১০ টাকা টিকিট কেটে আউটডোরে ডাক্তার দেখাতে হয়। ডাক্তার ভর্তির জন্য মনোনীত করলে রোগীর ইউপি চেয়ারম্যান বা পৌর চেয়ারম্যান বা মেয়রের নাগরিক সনদসহ রক্তের সম্পকিত অভিভাবককে আইডি কার্ডসহ উপস্থিত থেকে জামানত দিতে হয়। অউটডোরে গেলেই  যে রোগী ভর্তি করতে পারবেন তা কিন্তু নয়। ওই দিন কয়টি সিট খালি হবে তার প্রাপ্যতা অনুসারে রোগী ভর্তি করা হয়। প্রথম দিন সিট খালি না হলে পরদিন সকালে আবার টিকিট কেটে চিকিৎসক দেখাতে হয়। সেদিন সিট খালি হলে ভর্তি হতে পারবেন তা না হলে পরদিন আবার একই নিয়মে চিকিৎসক দেখাতে হবে। তবে প্রথম দিন রোগীকে ভর্তি করাতে না পারলে মানসিক রোগীকে নিয়ে শহরে হোটেলে উঠতে হয়। আর মানসিক অসুস্থ রোগী নিয়ে হোটেলে ওঠার যে কি অসহনীয় যন্ত্রণা তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। সিট প্রাপ্যতার এ সমস্যার সুযোগে স্থানীয় দালাল রোগীর অভিভাবককে ভাগিয়ে নিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে অনেক টাকার বিনিময়ে ভর্তি করান। আর এ জন্য হাসপাতাল এলাকাসহ শহরে বেশ কয়েকটি বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে হাসপাতাল স্টাফদের মালিকানায় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৮ বছরের নিচে ও ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, মৃগী রোগীসহ শারীরিক কোনো কঠিন রোগে আক্রান্তদের ভর্তি নেওয়া হয় না। একজন রোগীকে কমপক্ষে ২ মাস হাসপাতালে রাখা হয়। ধরন অনুযায়ী কোনো কোনো রোগীকে ৩ থেকে ৪ মাসও রাখা হয়। বাবা-মা, আপন ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ রোগীর অভিভাবক হতে পারবেন না। মাদকাসক্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যে কোনো বেড নেই। ভর্তি ফি ১৫ টাকা। এদের ভর্তির সময় মাসে ৮০২৫ টাকা করে ২ মাসের ১৬০৫০ টাকা অগ্রিম জমা দিতে হয়। এখানে বিনা মূল্যে আধুনিক ওষুধ খাবার সরবরাহ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীরা এক থেকে দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফির যান। অনেক ক্ষেত্রেই সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার রোগ বারবার দেখা দিলে আবার ভর্তি নেওয়া হয়। বহির্বিভাগে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী দেখা হয়। বহির্বিভাগে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কার্যক্রম চলে। সরকারি ছুটি ব্যতীত প্রতিদিনই হাসপাতালে বহির্বিভাগ চালু থাকে।
বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতালটি কনসালট্যান্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়াই চলছে। মানসিক চিকিৎসা সাধারণ চিকিৎসার নয় এটি দলগত চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত হলেও লোকবলের অভাবে তা ব্যাহত হচ্ছে। এখানে কোনো উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক নেই। নার্সিং সুপারভাইজার ৫জন থাকায় ১৩টি পুরুষ ওয়ার্ডে সেবাদান সম্ভব না হওয়ায় মহিলা নার্সিং কর্মকর্তার মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। যা খুবই দুঃসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও হাসপাতালে ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হয় না। হাসপাতালে ৩০ জন চিকিৎসকসহ মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৬৪৩ জন। বর্তমানে একজন পরিচালকসহ ১৩ জন চিকিৎসক, ২৮০ জন নার্স এবং ৪০ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আছেন। আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা, অ্যানেসথেটিস্ট, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট, বায়োক্যামিস্ট, ডেন্টাল সার্জন ছাড়াই কোনো রকমে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে ২ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পদ থাকায় তাদের প্রতিদিন ৫০০ ভর্তিকৃত রোগী ছাড়াও  বহির্বিভাগে ২৫০-৩০০ রোগীর চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এখানে হাসপাতালে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পদকে ফিডার পদ ধরা হয় না। তার অর্থ হলো এ হাসপাতালে দায়িত্বের সময়কাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভিজ্ঞতা যোগ না হওয়ায় পদোন্নতিতে কাজে লাগে না। তাই এখানে কেউ থাকতে চান না। শিক্ষানবিস চিকিৎসকেরা এই হাসপাতালে প্রশিক্ষণ ও নিতে চান না। এখানে কোনো উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক নেই। নার্সিং সুপারভাইজার পাঁচজন হওয়ায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালে ১৩টি পুরুষ ওয়ার্ডে পুরুষ নার্সিং কর্মকর্তা খুবই কম। তাই পুরুষ ওয়ার্ডে মহিলা নার্সিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হয় যা ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হয় না। সংকট রয়েছে সাইকোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট ও তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার অংশ কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি হলেও সাইকোথেরাপিস্ট অভাবে তা দেওয়া যাচ্ছে না। এখানে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও নেই টেকনিশিয়ানের অভাবে ইইজি মেশিন নষ্ট হচ্ছে। নেই শিশুদের চিকিৎসায় ইনডোর সুবিধা। নেই অকুপেশনাল থেরাপি বা স্পিচ থেরাপির ব্যবস্থা।
আরও আশ্চর্য যে মানসিক হাসপাতালে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের সুবিধা না থাকায় অনুমাননির্ভর চিকিৎসা চালু রয়েছে। যে সব রোগীর প্যাথলজি টেস্ট জরুরি তাদের পাবনা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। মানসিক অসুস্থদের যারা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। রোগীদের চিত্তবিনোদনে ক্যাম্পাসে ১টি সিনেমা হল থাকলেও সেটিও বহুকাল বন্ধ থাকায় মেশিনপত্র ও নষ্ট হয়েছে। নিয়মিত খেলা ধুলাসহ চিত্তবিনোদন চিকিৎসার অংশ হলেও সেখানেও চলছে বন্ধ্যত্ব। জনবলের অভাবে চালু হচ্ছে না হাসপাতালের বৃত্তিমূলক বিভাগ। বন্ধ রয়েছে রেডিওলজি সেবা।  এখানে বাইরে থেকে খাবার আনার নিয়ম নেই ক্যান্টিন সুবিধা ও নেই। রোগী চাইলেই নিজের টাকায় খাবার কিনতে পারেন না। মানসিক হাসপাতালের রোগীদের খাবারের বরাদ্দ হচ্ছে বিকেলে নাস্তাসহ ৪ বেলা ১৭৫ টাকা। দ্রব্যমূল্যের এ বাজারে ১৭৫ টাকায় ৪ বেলার খাবার দেওয়াটা প্রায় দুঃসাধ্য। তাই খাবারের মান যে কি হতে পারে তা বুঝতে সময় লাগে না।
নার্সদের কোয়ার্টার না থাকায় অধিকাংশই শহর থেকে যাতায়াত করেন। তাদের কোনো পরিবহন সুবিধা নেই। অধিকাংশ ভবন অনেক আগেই গণপূর্ত বিভাগ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। কর্মচারী সংকটে হাসপাতালের অভ্যন্তরে বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নেই ড্রেনেজ সিস্টেম আর ভাঙাচোরা রাস্তার দুর্দশা বলার কিছু নেই। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাত জেগে অভিভাবকরা সকালে রোগী নিয়ে হাসপাতালে এলেও রেস্ট নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে ডরমেটরি থাকলে রোগীর অভিভাবকদের শহরের হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়ানোর দুর্ভোগ পোহাতে হতো না বলে ও সংশ্লিষ্টরা জানান।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মানসিক টিকিৎসায় আরও বড় সংকট সৃষ্টি করছে। মানসিক রোগ শরীরের অন্য রোগের মতই একটি রোগ তা যেন সমাজ মানতে চায় না। মানসিক রোগী আজও সমাজে অস্পৃশ্য তাই তাকে পাগল বলে ডাকা হয়। মানসিক রোগীকে পাগল বলা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও সামাজিক সচেতনতার অভাবে পরিবার সমাজ থেকে মানসিক রোগীরা অবহেলা ঘৃণার শিকার। এ কারণে অনেক রোগী চিকিৎসায় ভালো হলেও তাদের বাড়ি বা সমাজে ঠাঁই হচ্ছে না। পাবনা মানসিক হাসপাতালে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ কেটে গেলেও ২১ রোগীকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। এদের ১০জন মানসিক হাসপাতালেই মৃত্যু হয়েছে। আরও অবাক যে এদের মৃত্যুর খবর দেওয়া হলেও কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেনি। বর্তমানে সুস্থ হয়ে ১১ রোগী বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকলেও কেউ নিতে আসছেন না। এ ১১ রোগী নিয়ে বিপাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পাবনা মানসিক হাসপাতালে সবচেয়ে পুরনো রোগী আবু সাঈদ হোসেন। ১৯৯৬ সালে ভর্তির পর সুস্থ হলেও কেউ নিতে আসছেন না। তাই বছরের পর বছর হাসপাতালে বন্দি থেকে আবারও মানসিকভাবে হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। এমনই ডলি খাতুন, মিনহাজসহ ১১ রোগী প্রতিদিন বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে রোগীরা সুস্থ হওয়ার পর তাদের ঠিকানা অনুযায়ী গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলে কেউ তাদের গ্রহণ করতে চায়নি। অনেক পরিবারে রোগী নিয়ে গিয়ে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের নাজেহাল হতে হয়েছে।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের দৃশ্যমান একটি বড় অন্তরায় হচ্ছে দর্শনার্থীদের উৎপাত। শহরে কেউ বেড়াতে এলে তারা মানসিক হাসপাতাল ঘুরে দেখতে চান। তাদের অনেকেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রোগীদের কাছে গিয়ে দেখা যেমন করেন তেমনি গল্পও করেন। যারা ভিতরে যেতে পারেন না তারা হাসপাতাল অভ্যন্তরে রাস্তার পাশের ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গে দূর থেকে ডাকাডাকি কথা বলার চেষ্টাসহ হাসি তামাশায় মেতে ওঠার ঘটনা নিত্যদিনের। দর্শনার্থী হাবভাবে মনে হয় মানসিক হাসপাতালের রোগীরা যেন চিড়িয়াখানার জীবযন্তু। হাসপাতালের চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অভিমত দর্শনার্থীরা রোগীর সঙ্গে কথা বলায় রোগীদের সুস্থ হওয়া বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। তাই দর্শনার্থীদের ঢুকতে না দেওয়াসহ রাস্তার পাশের ওয়ার্ডে দর্শনার্থীরা যেন রোগীদের উত্ত্যক্ত করতে না পারেন সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা দরকার বলে মনে করেন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাফ্ফাত ওয়াহিদ জানান অভিভাবকদের মধ্যে একটি ধারণা শুধু এই একটি হাসপাতালেই মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় বিষয়টি তা নয়। এখন প্রায় প্রতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই না জেনে অনেক কষ্ট করে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে তো সব ধরনের রোগীকে ভর্তি করা হয় না। চিকিৎসকদের প্রাথমিক পরামর্শক্রমেই এখানে রোগী ভর্তি করা হয়। লোকবলসহ পুরাতন ভবনের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছে তবে অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে। এই হাসপাতাল আরও উন্নত করার জন্য এর পাশেই একটি ৬০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল নির্মাণের মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটির নকশা ও অনুমোদন চূড়ান্ত পর্যায়ে সব ঠিক থাকলে খুব দ্রুতই হয়তো ভবন নির্মাণ শুরু হবে। তখন আরও ভালোভাবে মানসিক রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দেশের মানসিক চিকিৎসা সেবায় পরিবর্তন আনতে হলে সুসংগঠিত পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ পদ ফিডার পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে বিশেষজ্ঞরা সেখানে থাকতে উৎসাহী হবেন বলে চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত সূত্র জানান। আর তখন শিক্ষানবিস চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ নিতে আগহী হবেন। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, লোকবল নিয়োগ, নতুন ভবন নির্মাণসহ দুর্নীতি অনিয়ম রোধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ আজ সময়ের দাবি বলে সুধিজন মনে করছেন।
কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা
ও লুৎফর রহমান, সাঁথিয়া

 

×