
.
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক আব্দুল মতিনের জন্মভূমি চৌহালীর যমুনা চরাঞ্চলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এ বছরও কলাগাছের তৈফা শহীদ মিনারে মাতৃভাষা ও শহীদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছে। শুক্রবার সকালে ভাষা মতিনের গ্রাম শৈলজানা নিম্ন মাধ্যমিক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে দিবসটি পালন করা হয়। এজন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরা কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার ও স্কুলের বেঞ্চ দিয়ে বেদি তৈরি করে। চারপাশ রঙিন কাগজ দিয়ে পতাকা টাঙিয়ে রাখে। একে একে শ্রদ্ধা জানায় শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ গ্রামবাসী। ঠিক তখনই যমুনা বিধ্বস্ত চৌহালী উপজেলার উমারপুর ইউনিয়নের শৈলজানা চরে ভাষা মতিনের গ্রামে নেই কোনো আয়োজন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভাষা মতিনের কর্ম ও চিন্তা নিয়ে গবেষক হান্নান মোর্শেদ রতন। তিনি জানান, মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন বাজী রাখা বীরপুরুষ তার গ্রামেই অবহেলিত। এর চেয়ে লজ্জা আর কিছুই নেই।
শৈলজানা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাসুদ রানা জানান, অবহেলিত চর এলাকায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। এজন্য এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বাড়ির উঠানে শহীদ মিনার তৈরি করে শহীদ দিবস পালন করছে। সারাদেশে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার থাকলেও ভাষা মতিনের এলাকায় বরাবরই অবহেলিতই রয়ে গেল। চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) জুয়েল মিয়া জানান, ভাষা মতিনের এলাকায় শহীদ মিনার নির্মাণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।যেসব আকরগ্রন্থে
বাঙালির ভাষার
লড়াই...
জনকণ্ঠ ফিচার
একুশ এলো অমর একুশে বইমেলায়। এই দিনটি ঘিরেই মাসব্যাপী আয়োজন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অবিস্মরণীয় এক ইতিহাস রচনা করেছিল বাঙালি। জিন্নাহর উর্দু গেলানোর ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। ফলে একুশের দিনের মেলায় অন্যরকম আবেগ পরিলক্ষিত হয়। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জনস্রোত নেমে আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তবে এবার দিনের প্রথমার্ধে মেলায় উপস্থিতি ছিল খুবই কম। সকাল সকাল প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হলেও, শূন্য পড়ে ছিল স্টল প্যাভিলিয়ন। দুপুরের পরও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। অবশেষে বিকেলের দিকে ভিড় বড়তে থাকে। দিনশেষে বই বিক্রিও একেবারে কম হয়নি।
২১তম দিনে মেলা ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের বই-ই বিক্রি হচ্ছে। বাঙালির ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস নির্ভর বইগুলো সামনের দিকেই রেখেছিলেন প্রকাশকরা। এসব বইয়ের প্রতি খুব নজর ছিল পাঠকেরÑ এমনটি বলা যাবে না। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিক ইতিহাসের আকর গ্রন্থগুলো মেলায় পাওয়া গেছে ঠিকই। এ সংক্রান্ত কয়েকটি বইকে অবশ্য পাঠ্য বলে বিবেচনা করা হয়। দলিল দস্তাবেজে সমৃদ্ধ গবেষণামূলক মৌলিক বইগুলো না পড়লে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অনেক কিছু অজানা থেকে যায়। কোথায় পাওয়া যাচ্ছে এখন বইগুলো? খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, একেকটি বই একেক স্টল বা প্যাভিলিয়নে আছে। ইতিহাসবিদ ভাষা সংগ্রামী ও বিদগ্ধ পাঠদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী, ভাষা আন্দোলন বিষয়ে অবশ্য পাঠ্য প্রথম বইটি বশীর আল্ হেলালের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।’ যতদূর তথ্য, গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। দ্বিতীয় বর্ধিত ‘আগামী’ সংস্করণ আসে ১৯৯৯ সালে। ‘আগামী’ বলতে, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আগামী। এখন পর্যন্ত এখান থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে অমূল্য গ্রন্ধ। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ে না। বরং বইয়ের ভূমিকা থেকে কিছু কথা তুলে ধরা যাক। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য, তার দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যগুলোকে যাতে ধরতে সুবিধা হয় এ- গ্রন্থে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের পরিচয় ও চরিত্রই বা কী দাঁড়িয়েছিল শেষ পর্যন্ত? তার কতখানি ছিল সাংস্কৃতিক আর কতখানি রাজনৈতিক? এসব প্রশ্নের জবাব একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতোই সহস্র দলিল দস্তাবেজের গভীরে গিয়ে গ্রন্থাকার তুলে এনেছেন। এই গ্রন্থে পূর্ব-বাংলার ভাষা-আন্দোলনের কেবল তথ্য ও ঘটনাবলীকে তুলে ধরা হয়েছে। লেখ্যগত প্রমাণ ও সমর্থন ছাড়া কোনো তথ্যের উল্লেখ বা ঘটনার উপস্থাপন করা হয়নি। বরং বহু প্রবন্ধে নিবন্ধে আলোচনায় স্মৃতিচারণে সাক্ষাৎকারে তথ্যের অজস্র বিভ্রম ঘটে গেছে। লেখক তার সংশোধন করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য নিরপেক্ষতা এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ভাষা আন্দোলনের ওপর এর চেয়ে পূর্ণতর ইতিহাস আর লেখা সম্ভব হয়নি।’ এসব বিবেচনায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে সারাবছরই বইটি সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন বিদগ্ধ পাঠক।
অভিন্ন গুরুত্বের জায়গা থেকে বিবেচনা করা হয় বদরুদ্দীন উমরের রচনাকে। ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শিরোনামে তিন খণ্ডে এ ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি। অজস্র সাক্ষাৎকার, দলিল নথিপত্রে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি। গোড়ার দিকে প্রকাশ করেছিল আনন্দধারা প্রকাশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পরে বইটি প্রকাশ করে মাওলা ব্রাদার্স। তবে বর্তমানে কারা প্রকাশ করছে তা জানা সম্ভব হয়নি। ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক পটভূমি তথা সমকালীন রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে এ বই। আন্দোলনের গুরুত্ব বিচার, বাঙালির জাতীয় জীবনে এর প্রভাব প্রতিক্রিয়া বুঝতে বইটি পাঠ করা আবশ্যক বলে বিবচনা করা হয়।
সাম্প্রতিককালে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রান্স অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থে। সিরিজ গ্রন্থের ভলিয়ম-১ পাঠে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ের নানা চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়।
সর্বশেষ সংযোজন বলা চলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছের লেখা ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ বইটিকে। পূর্বাপার সকল তথ্য সংগ্রহ, বই পাঠ ও বিশ্লেষণের আলোকে নতুন গ্রন্থটি রচনা করেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আসলে কে ছিলেন? এমন আরও দু’ একটি প্রশ্নে নতুন তথ্য দেয়া হয়েছে বইতে। প্রকাশ করেছে নালন্দা। প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে বইটি।
লেখক গবেষক এম আবদুল আলীমও ভাষা আন্দোলন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন। তার কয়েকটি কাজের মধ্যে অন্যতম ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জেলাভিত্তিক ইতিহাস।’ আগামী থেকে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পাঠে ভাষা আন্দোলনের জেলা ভিত্তিক ইতিহাস জানা যাবে। অবশ্য আরও নতুন নতুন বই মেলায় আসছে। অসংখ্য বই থেকে অমর একুশের প্রকৃত ইতিহাস ও এর তাৎপর্য উপলব্ধির চেষ্টা পাঠক করবে- আমাদের তা-ই প্রত্যাশা।
৩০৭ নতুন বই ॥ ২১তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ৩০৭টি। মেলা মঞ্চে একুশে বক্ততা ॥ বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৫। এতে ‘ভাষার লড়াই, গণ-অভ্যুত্থান ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
প্রাবন্ধিক বলেন, ১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে মাতৃভাষার অধিকার এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। ন্যায়সংগত, বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাক্সক্ষা নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে নিরন্তর সংগ্রাম করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আজ প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে পারি মাতৃভাষার অধিকার এবং নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্যের উৎস নির্মূল করতে হবে। সত্যিকারভাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে গেলে পরিবর্তনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয়ই নয়। এটি পরিবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটনের বিদ্যা। জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অগ্রসর হতে পারব।
লেখক বলছি মঞ্চ ॥ এই মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি মোহন রায়হান এবং কবি আবিদ আজম।