
.
বাঙালির মননের সুন্দরতম প্রকাশের প্রতীক অমর একুশে বইমেলার ষোলোতম দিন ছিল রবিবার। সেই সুবাদে শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা ফেলেছে দেশের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক আয়োজনটি। সাধারণত এই সময়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলে প্রাণের মেলা। দেখাদেখির পর্ব পেরিয়ে বই সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন বইপ্রেমীরা। সুসজ্জিত প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলে স্টলে ভিড় জমে গ্রন্থানুরাগীদের। কারণ, বেশিরভাগ প্রকাশনীর ছাপার অপেক্ষায় থাকা গল্প-কবিতা-উপন্যাস থেকে মননশীল বইগুলো চলে আসে বইয়ের এই উৎসবে। তাই পছন্দসহ বই সংগ্রহে পাঠককেও বেগ পেতে হয় না। এবার তেমনটা ঘটলেও কাক্সিক্ষত সাড়া পড়েনি পাঠকের। ফলশ্রুতিতে জমে ওঠেনি বইয়ের বিকিকিনি। তাই এদিন জনসমাগম বাড়লেও বই সংগ্রহের আশানুরূপ চিত্রটির দেখা মেলেনি। পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীর দেখা মিলেছে বেশি।
এ সময় মেলা গতিশীল না হওয়া প্রসঙ্গে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা এবং মবতন্ত্রকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, উচ্ছৃঙ্খল জনতার অপ্রীতিকর ও অনাকাক্সিক্ষত আচরণের কারণে স্টল বন্ধ হয়ে গেছে। হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে প্রকাশককে। একইভাবে কোনো লেখকের বই পছন্দ না হলে সেটির প্রদর্শন বন্ধ কিংবা বাজেয়াপ্ত করার মতো অন্যায় আবদারে লিপ্ত হচ্ছে মব সৃষ্টিকারী জনতা। এসবের প্রভাবে মেলার সৌন্দর্যহানি ঘটছে। মুক্তমনা কিংবা প্রগতিশীল মানুষদের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একইভাবে খ্যাতিমান লেখকরাও হাজির হচ্ছেন না মেলা প্রান্তরে।
বসন্তে বিকেলে কথা হয় প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাসমূহের প্রভাব পড়েছে এবারের মেলায়। তা ছাড়া বরাবরই মেলায় পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীর ভিড় বেশি থাকে। কিন্তু অন্য সময়ে দর্শনার্থীর ভেতর থেকেও যে পাঠকসমাগম ঘটত এবার সেটা কমে গেছে। আগে যেসব পাঠক একাধিকবার আসতেন তারা হয়তো একবার আসছেন। তাই বই বিক্রিসহ সার্বিকভাবে মেলা জমে উঠেছে-সে কথা বলা যাচ্ছে না। আশা করছি, আগামী কয়েকদিনে এই দৈন্যদশার অবসান হবে। পাঠকে মুখরিত হয়ে জমজমাট রূপ নেবে প্রাণের মেলা।
মেলায় দেখা হয় সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল লেখক স্বকৃত নোমানের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে এই কথাশিল্পী বলেন, মূলত চারটি কারণে এখনো জমে ওঠেনি বইমেলা। ফলে আশানুরূপ বইয়ের বিক্রি হচ্ছে না। মেলার প্রথম দিনই ডাস্টবিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুক্তচিন্তার কিছু মানুষ আশাহত হয়েছেন। পাঠকরূপী এই মানুষদের একাংশ মেলাকে বর্জন করেছেন। এমন নয় যে তারা পতিত শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের সমর্থক। প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে বইমেলায় ঘৃণার চর্চা দেখে তারা মর্মাহত হয়েছেন। এরপর তসলিমা নাসরিনের ‘চুম্বন’ নামের বইকে কেন্দ্র করে সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে হামলা এবং ওই স্টল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ধরনের মব জাস্টিসের কারণে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণেই এখনো পর্যন্ত বইয়ের বিক্রি খুবই হতাশাজনক। বেশিরভাগ প্রকাশনা সংস্থাই বই বিক্রিতে মন্দার কথা বলছে। এ ছাড়া মধ্যবিত্তের হাতে টাকা না থাকায়ও এমনটা ঘটছে। অতিরিক্ত মূল্যের কারণেও বই কম বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা ছন্দপতন ঘটেছে।
স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির কারণে দুই স্টল বন্ধ : বইমেলায় নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির কারণে এদিন বিকেলে দুইটি স্টল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। মেলা কর্তৃপক্ষ বলছে, বইমেলায় অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রির জন্য স্টল দুইটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা যায়, নারী ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যের ব্র্যান্ড ‘স্টে সেইফ’ বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দুইটি স্টল পরিচালনা করছিল। মেলার শুরু থেকেই তারা স্টল চালিয়ে আসছে। রবিবার সরেজমিনে স্টল দুইটি বন্ধ দেখা যায়। কালো কাপড় দিয়ে স্টল ঢেকে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. সরকার আমিন বলেন, বইমেলার নীতি অনুযায়ী মেলায় বই ও খাবার ছাড়া অন্য কিছু বিক্রির সুযোগ নেই। তাই স্টল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন বলে নয়, যে কোনো অনুমোদনহীন পণ্যের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
একাডেমির সচিব ও বইমেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান সেলিম রেজা বলেন, মেলায় অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রির জন্য স্টল দুইটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি।
নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এদিন নতুন বই এসেছে ১০৪টি। এর মধ্যে বেঙ্গল বুকস থেকে এসেছে পিয়াস মজিদের কাব্যগ্রন্থ ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’। কথাপ্রকাশ এনেছে উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনধর্মী নাসির আলী মামুনের উপন্যাস ‘হেম বেহাগের মহারাজা’। আয়েশা মুন্নির কাব্যগ্রন্থ ‘গুলবাহার ভোর’ এনেছে বুনন প্রকাশন। ৩৫৬ নং স্টলে কাব্যগ্রন্থটি পাওয়া যাচ্ছে। বেহুলা বাংলা এনেছে সুমন শামসের কাব্যগ্রন্থ ‘বারুদের বিসংবাদ’। ভাষাপ্রকাশ এনেছে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ও ড. মিজান রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাশ : জীবন ও সাহিত্য’। আলোঘর এনেছে বিরূপাক্ষ পালের অর্থনীতিবিষয়ক বই ‘ফাইন্যান্সের সহজ কথা’। একই প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে মনির জামানের ‘বিদ্রোহী তিতুমীর’। পাঞ্জেরী এনেছে পলাশ মাহবুবের অনুকাব্য ‘পমার বচন ২’। বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে ঝুমকি বসুর গল্পগ্রন্থ ‘ছাতিম ফুলের গন্ধ’। পথিক প্রকাশন এনেছে সুরমা জাহিদের ‘স্ব স্ব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত নারী’। একই প্রকাশনী এনেছে আসলাম সানীর কাব্যগ্রন্থ ‘সময় আসবে জগৎ হাসবে’।
মেলা মঞ্চের আয়োজন : এদিন বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে ঐতিহাসিক ঘটনার বিচার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহুল আহমদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মশিউল আলম এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন মাহবুব হাসান।
প্রাবন্ধিক বলেন, জহির রায়হান একাত্তরের বৈপ্লবিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই উত্তাল সময়ে তিনি বহুমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একদিকে তিনি ঘটনার জন্ম দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে ঘটনার বিবরণ বা বয়ান তৈরির কাজে লিপ্ত ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে জেনোসাইড শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে প্রামাণ্যচিত্র। জহির রায়হান একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহকে বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবেচনা করেছিলেন, তামাম দুনিয়াতে যে ধরনের আন্দোলন চলছে একাত্তর তারই অংশ।
আলোচকদ্বয় বলেন, জহির রায়হান ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্য নির্মাতা, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রবন্ধকার। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে তিনি তাঁর অমিত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শোষণের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন ও দৈনন্দিন বাস্তবতার কথা। তিনি শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সে লক্ষ্যেই আজীবন কাজ করে গেছেন।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও গবেষক সুমন সাজ্জাদ এবং শিশুসাহিত্যিক শরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল ইসলাম রনি এবং ডা. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। ছিল মো. আবুজার গিফারীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পতরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মোবাস শিরীন মোস্তফার পরিচালনায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন দেবিকা রানী পাল, জাহিন খান নেজাম, আনিলা আমীর লামী, সুমন চন্দ্র দাস, মো. টিপু চৌধুরী, মিতালী সরকার ও ডালিয়া সুলতানা।