![ভালোবাসার রং ফাগুন হাওয়ায় ভালোবাসার রং ফাগুন হাওয়ায়](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/5-2502131747.jpg)
.
আজি দখিন-দুয়ার খোলা-/এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...। বাঙালির বসন্ত এসেছে। আজ শুক্রবার ১ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথমদিন। অন্যদিকে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার মহানুভূতির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার দিন। শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার বিশেষ দিবস। উৎসব দুটি হলেও অভিন্ন হৃদয়াবেগকে ধারণ করে। বসন্তে মনে যে পুলক জাগে তারই আরেক নাম ভালোবাসা। আবার ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে তীব্র করে বসন্ত।
ফাগুনের কথাই আগে বলা যাক। প্রতিবারের মতোই রাঙিয়ে দিতে এসেছে ফাগুন। শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দিতে এসেছে। ‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে/এই নব ফাল্গুনের দিনে...।’ আবারও এসেছে নব ফাল্গুনের দিন। ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...।’ একেবারে বুকের ওপর দিয়ে বইছে বসন্তের বাতাস! ‘বসন্ত, দাও আনি,/ফুল জাগাবার বাণী-/তোমার আশায় পাতায় পাতায় চলিতেছে কানাকানি।’ অনেকদিন ধরেই কানকানি চলছিল। প্রিয় ঋতু যে আসছে, নানাভাবে তা বোঝা যাচ্ছিল। আর তারপর নজরুল যেন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন।’ অবশ্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এত অনুষঙ্গ খুঁজতে যাননি। তার বলাটি ভারি অদ্ভুত। কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত।’ অর্থাৎ, সব অস্বীকার করে হলেও, কিঞ্চিত অবহেলা করে হলেও বসন্তকে ভীষণভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি! আর নির্মলেন্দু গুণ বসন্তকে ‘আগ্রাসী’ বলে মন্তব্য করেছেন। আগ্রাসন সহাস্যে মেনে নিয়ে কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,/যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য।’
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতি দুই মাস অন্তর রূপ বদলায় প্রকৃতি। শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। আর সমাপনী ঋতুটি বসন্ত। ফাল্গুন চৈত্র মিলে বসন্তের বৈশিষ্ট্য গড়ে দেয়। এ সময় শীতে ভুগতে হয় না। গরমও থাকে সহনীয় পর্যায়ে। সময়টা তাই ভীষণ উপভোগ করে বাঙালি। এরই মাঝে বদলাতে শুরু করেছে প্রকৃতি। শীতে বিবর্ণ প্রকৃতি জেগে উঠছে নতুন করে। বৃক্ষের নবীন পাতায় এখন কাঁচা সবুজ। রোদ এসে পড়তেই চিক চিক করছে। আর বাগান সব ভরে উঠেছে ফুলে। গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্ল্যাডিওলাস ইত্যাদির সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে টিউলিপও। নাগরিক উদ্যানে বনে পার্কে তারও আগে থেকে ফুটে আছে ফাগুনে
অনিবার্য পলাশ শিমুল। চারপাশের এসব দৃশ্য দেখেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ওরে ভাই, ফাগুন এসেছে বনে বনে-/ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,/আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’
এখন রঙিন ফুলের আকর্ষণে উড়ে আসছে প্রজাপতি। মৌমাছিরাও ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। ফুলের বাগানে গুনগুন। পাখিরা প্রণয়ী খুঁজছে। দূরে গাছের ডালে বসে ডাকছে কোকিল। মানুষের চঞ্চল মন আপনি গেয়ে উঠছে ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।’ বাঙালির মন, হ্যাঁ, বসন্তে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিশেষ প্রভাবিত হয়। আর মনে রাজত্ব করে বলেই তো সে ঋতুরাজ।
কবি নির্মলেন্দু গুণে ফিরে যাওয়া যাক, কবি লিখছেন, ‘দোলা চাই অভ্যন্তরে,/মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর। ...এ না হলে বসন্ত কিসের?’ বসন্ত আসলেই আরও এক মনের মর্মর। গভীর গোপন ভালোবাসার অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে। উস্কে দেয়। স্বীকার করে নিয়েই যেন কবিগুরু বলেন, ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল।’ বসন্ত ভালোবাসার বোধগুলোকে তীব্র করে। তৃষ্ণার্ত করে তুলে হৃদয়কে। কাতর করে তুলে। ভালোলাগা ভালোবাসার সৌরভ ছড়ানো বসন্ত মিলনের বার্তা দেয়। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজে, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে।’ লোকজ সুরেও ধ্বনিত হয় অভিন্ন বাসনা। আব্বাসউদ্দীনের কালজয়ী কণ্ঠ গেয়ে ওঠে- সুখ বসন্ত দিলরে দেখা, আর তো যৈবন যায় না রাখা গো...। আর যারা বসন্তেও বাঁধে না ঘর, বাঁধতে পারে না যারা, তাদের বেদনা অপার। বেদনাকে নিয়েও খেলা করে বসন্ত। তেমনই বেদনার কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান/ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-/দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে...। অভিন্ন অনুভূতি থেকে কবি মহাদেব সাহার বলাটি এরকম- তোমার সঙ্গে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই অনিঃশেষ বসন্তকাল।
ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসটিও আজ স্মরণ করা হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবী জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা-সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় কিছু কাগজের টুকরায় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরা তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত, তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনো কখনো ওই দুজনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনো কখনো তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এ রকম- সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে, ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন, বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দি থাকাবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। একপর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সেদিনই ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/মনের মন্দিরে...।’ লেখা হয়েছে কি প্রিয় নাম? বলা হয়েছে, ‘ভালোবাসি’? আজ বলুন। ভালোবাসার শক্তিতে সুন্দর সমাজ, প্রেমময় পৃথিবী গড়ার শপথ নেওয়ার আজই তো দিন। আজ ভালোবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে হৃদয়। সারা পৃথবীর মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হবে ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেবেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে হবে ভালোবাসার আদান-প্রদান। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় উঠবে লাল গোলাপ।
কিন্তু যে ভালোবাসা নিয়ে এত কথা, সেই ভালোবাসা আসলে কী? ‘প্রেম’ কাকে বলে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনন্তকাল ধরে খোঁজা হচ্ছে। সহজ কোনো উত্তর নেই। হয় না। কবিগুরু তাই হয়তো লিখেছিলেন, ‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম...।’ অন্যদিকে, যারা নামটি জানেন। তবে তাকে বলতে পারেন না ‘ভালোবাসি’, সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে কবিগুরু লিখেছেন: ‘আমি যে আর সইতে পারি নে।/সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা...।’
প্রেমের কবি নজরুল প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে গেয়েছিলেন: ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে।’ ভাটিবাংলার সাধক কবি হাছন রাজাও প্রেমে পড়েছিলেন। তীব্র সেই অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি গেয়েছিলেন: ‘নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে...।’ তার ‘নিশা’ আর কাটেনি কোনোদিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর-বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুরে সুরে বলেছিলেন, ‘ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে...।’ আর রাধারমনের তো প্রাণ যায় অবস্থা! তিনি গাইলেন, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না...।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের কণ্ঠে। তাঁর বলাটি- ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া...।’ মনের মানুষ ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালোবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালোবাসার জন্য।
রাজধানীতে বসন্ত উৎসব ॥ প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীতে আয়োজন করা হচ্ছে বসন্ত উৎসবের। ঢাকার কয়েকটি মঞ্চ থেকে আজ প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেওয়া হবে। মূল গন্তব্য হবে চারুকলার বকুল তলা। এখানে সকালে উৎসবের সূচনা করা হবে। আয়োজক জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। আয়োজকদের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট জানান, সঙ্গীত নৃত্য আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করে নেওয়া হবে।
একই দিন ভালবাসা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে। ফলে, বাসন্তী রং এবং ভালোবাসার লাল- দুটো রং-ই দেখা যাবে একসঙ্গে। যথারীতি শাহবাগ, টিএসসি, চারুকলাসহ আশপাশের এলাকায় উৎসবপ্রেমীদের মূল স্রোতটি দৃশ্যমান হবে। এখান থেকে ছড়িয়ে পড়বে গোটা শহরে। সারাদেশেই উদ্যাপিত হবে পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস।