তিনি বলতেন, কবিতা স্রষ্টার দান। তা উপর থেকে নাজিল হয়, ভেতর থেকে উঠে আসে। ইচ্ছে করলেই আর যাই হোক কবিতা রচনা করা যায় না। তাকে খুঁজতে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, সে আপন ইচ্ছাতেই কবির কাছে ধরা দেয়।
বলছিলাম, আল মাহমুদের কথা। কবি আল মাহমুদ। বাংলা কবিতার রাজপুত্র। একটি পূর্ণ জীবন যিনি অকাতরে ব্যয় করে গেছেন শুধু কবিতার জন্য। বলেছেন, সারাজীবন কবিতা ছাড়া কিছুই বুঝিনি। কবিতাই আমার ধ্যান জ্ঞান বিধাতা। কবিতার ঝুলি নিয়ে আমি জন্মগ্রহণ করেছি আবার সেটা সঙ্গে নিয়েই আমি ফিরে যাব। তিনি তার কথা রেখেছেন। তিতাসের গন্ধমাখা কবি কবিতাময় একটি জীবন কাটিয়ে আবার ফিরে গেছেন সেই শৈশবের সাথী প্রিয় তিতাসের কাছেই।
বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ একটা মিথ। তার প্রতিটি কবিতা সহজ সরল ভাষায় বাঁক খেতে খেতে একসময় অনন্য হয়ে যায়। কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাকে ডাকতেন, ‘শব্দ জাদুকর’ নামে। বলতেন, মাহমুদের হাতে জাদু আছে। ‘ও’ শব্দ নিয়ে খেলতে জানে। আর এই জানা- ই ওকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
আল মাহমুদ সত্যিই অন্যদের থেকে আলাদা একজন কবি। নিজস্ব একটি কাব্যভাষা তিনি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খুব সাধারণ একটি বিষয় তার লেখনী জাদুতে অসাধারণ হয়ে উঠতো। তিনি বলতেন, কবিতা হচ্ছে শব্দের চাল। যিনি এই চালে যত কৌশলী তিনি ততটাই সফল। ঠিক দাবার মতো।
নিজেকে বারবার ভেঙে আবার নতুন করে নির্মাণের মধ্যে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতেন। এ জন্যই তার কবিতার শরীর ও নির্মাণ এক সময় থেকে অন্য সময়ে ভিন্ন। ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’র আল মাহমুদ যেমন ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ এর থেকে ভিন্নতর ঠিক তেমনি ‘কালের কলস’ থেকে ভিন্ন চরিত্র নিয়ে বেড়ে ওঠা ‘সোনালী কাবিন’। বাংলা কাব্য সাহিত্যে আল মাহমুদ একটি কিংবদন্তি, একটি বিস্ময়। কবিতাকে কিভাবে মেদহীন অথচ চিত্রল করে তুলতে হয় তা তিনি শিখিয়ে গেছেন তার উত্তরসূরিদের। একজন স্বশিক্ষিত কবির কবিতা নিয়েও যে গবেষণা হতে পারে- ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ সম্ভব, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের পর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বুঝি আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ এবং মানুষ আল মাহমুদের মধ্যে কেউ কেউ বিভাজন সৃষ্টির প্রয়াস পেলেও তার কবিতার সারল্য সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
আল মাহমুদ, একমাত্র আল মাহমুদেই সম্ভবÑ কবিতাকে কুড়ানো হাঁসের ডিম, বাবার সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি কিংবা মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তারের সঙ্গে তুলনা করা। আল মাহমুদ এটি করতে পেরেছেন আর পেরেছেন বলেই তার কবিতা কালের কণ্ঠস্বর হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে; সর্বত্র।
সোনালি কাবিন পড়ে আল মাহমুদকে কাম ও প্রেমের কবি হিসেবে উল্লেখ করতে চান অনেকেই। কিন্তু পরবর্তী জীবনে বিধাতাক্রান্ত আল মাহমুদকে মৌলবাদী হিসেবে শনাক্ত করার অপচেষ্টাও যে দৃশ্যমান হয়নি তাও নয়। আল মাহমুদ প্রেমিক, তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু সে প্রেমের প্রকৃত ব্যাখ্যা খুব যে সহজ তা নয়।
নারী থেকে বিধাতায় স্থানান্তরিত আল মাহমুদ কাব্য সমালোচকদের কাছে একটি বিশাল বিস্ময় হয়ে আছেন। আল মাহমুদ অবশ্য এসব নিয়ে তেমন মুখ খোলেননি। একটি সাক্ষাৎকারে শুধু তিনি তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি চিরকাল সাম্যের অনুসারী। প্রথম জীবনে সমাজতন্ত্রের মধ্যে আমি সেই সমতার চিত্র লক্ষ্য করে তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলাম কিন্তু পরিণত বয়সে যখন আমি দেখলাম সেটা শুধু খণ্ডিত চিত্র মাত্র এবং এর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে আমারই ধর্মে। তখন আমি আমার ধর্ম এবং সৃষ্টিকর্তায় স্থিত হই। আমার এই পরিবর্তনকে অনেকেই সহজে মেনে না নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি কোনো পথ বদল করিনি, ক্ষুদ্র আস্থা থেকে বিরাট আস্থায় নিমজ্জিত হয়েছি মাত্র। ওই একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমাকে এখন একটি শ্রেণি মৌলবাদী বলে আনন্দ লাভ করে। মৌলবাদী বলতে তারা ধর্মবাদীকে বুঝাতে চায়। অবশ্যই আমি আমার বিধাতা এবং ধর্মে পরিপূর্ণ আস্থাশীল। তবে আমি ধর্মান্ধ নই। ধর্মভীরুতার সঙ্গে ধর্মান্ধতার পার্থক্য আছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু তাই বলে তারা ধর্মান্ধ নয়। আক্রান্ত যদি বলা হয়, তবে আমি সব সময় একজন বিধাতাক্রান্ত মানুষ, কখনোই ধর্মাক্রান্ত নই।
আল মাহমুদ কবিতাকে শুধু কবিতা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেছেন এটি তার ইবাদত। আর যেটি ইবাদত সেটি কখনো গৌণ কোনো বিষয় হতে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় মমতা, ভালোবাসা, নিবেদন। যা আত্মার নির্যাস তা চিরকালই পবিত্র এবং অমরতায় পরিপূর্ণ। আল মাহমুদে তাই আমরা প্রত্যক্ষ করি একটি সহজ সরল অথচ গভীর অর্থবহ সমর্পণের ইঙ্গিত। একজন কবি যখন তার মন ও মননের সবটুকুকে একটি পরম প্রার্থনায় গ্রথিত করেন তখন তিনি আর সাধারণ মানুষ থাকেন না, হয়ে যান আলাদা কোনো কেউ, কোনো বিশেষ একজন। আল মাহমুদ সেই বিশেষ একজনদের একজন। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া হয়েছে, তার বিশ্বাসের ঘরে কলঙ্ক লেপনের অপচেষ্টা চলেছে। কিন্তু তাতে তার বিশ্বাসের বিশালত্ব এতটুকু সংকুচিত হয়নি।
বিধাতাক্রান্ত আল মাহমুদ উড়ে গেছেন তার পরম আশ্রয়ে। তাকে স্পর্শ করে এমন সাধ্য কার? বিশাল আকাশকে যেমন ক্ষুদ্র চোখে বেষ্টন করা যায় না, তেমনি সমুদ্রের অতলতাকে মাপা যায় না কোনো চেতনা দিয়ে তা যতোই দীর্ঘ হোক। আল মাহমুদ শারীরিক উচ্চতায় খর্বাকৃতি হলেও মনের উচ্চতায় ছিলেন পর্বতের চেয়েও দীর্ঘ, ঠিক তার কবিতার মতো। পরনিন্দাকারী মানুষের কী এমন সাধ্য তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে?
আল মাহমুদ চেয়েছিলেন পবিত্র জুম্মাবারে নশ্বর এই পৃথিবীর মায়া কাটাতে। আর সে ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তার কবিতাতেওÑ
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয় আহার, মৈথুনÑ
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়;
অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন
কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবী নিশ্চয়,
স্মৃতির মেঘলা ভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিন্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ-পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।’
(স্মৃতির মেঘলা ভোরে)
বিধাতা তার আকাংখা পূরণ করেছেন। পবিত্র শুক্রবারে পাখি হয়ে পরপারে পাড়ি দেয়া আল মাহমুদ আজ যেন দূরের আকাশে এক চিলতে প্রিয়প্রাঙ্গণ, একটি নক্ষত্র মাত্র। কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়, আল মাহমুদও তেমনি ভাবেই বেঁচে থাকবেনÑ তার কবিতার মধ্য দিয়ে অনাগত কাল অযুত ভক্তের হৃদয়ে।