ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যে বসন্ত প্রশস্তি

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৯:২১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলা সাহিত্যে বসন্ত প্রশস্তি

বসন্ত রঙের ঋতু, বসন্ত প্রতিবাদের ঋতু। বসন্ত কখনো প্রেমের কখনো বিরহের। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষগুলো বসন্ত এসে পায় যৌবনের উন্মাদনা। মৃতপ্রায় নতুন ডালে আসে নতুন পাতার আশীর্বাদ। শুকনো মাটির বুক ফেটে গজিয়ে ওঠে মসৃণ সুন্দর ঘাস। বসন্ত আসে পাখির কলকাকলী আর অপার সবুজের সমাহার নিয়ে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি এ সময় নবরূপে সজ্জিত হয়। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা আর পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেতে সবুজের ঢেউ খেলে। বসন্তের আগমনে শীতের জড়া জীর্ণতা ও নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সজীব ও প্রাণবন্ত। বসন্তের ছোঁয়া মেলে গাছের নতুন কুঁড়িতে, মানুষের মন মননে। শীতে ম্রিয়মাণ প্রকৃতি বসন্তের জাদুময়ী স্পর্শে হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলিত হয় এবং মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। প্রকৃতি, ভালোবাসা আর প্রতিবাদের এই মাস বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও যাপিত জীবনের সর্বত্র নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও বসন্তের দেখা মেলে। আর ‘পদাবলী’ তো বাংলা সাহিত্যে বসন্ত স্তুতির মহাকাব্যস্বরূপ। এমনকি জয়দেবের সংস্কৃত শ্লোকেও এ ঋতুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলা কবিতায় বসন্তের আড়ম্বরপূর্ণ আগমনী বার্তা প্রথম পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের কবিতায়। আলাওল তাঁর কাব্যে বসন্তকে দেখেছেন কামের ঋতু হিসেবে। ‘ঋতু-বর্ণন’ কাব্যে তিনি লিখেছেন-
‘প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব।
দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব ॥
মলয়া সমীর হৈল কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ফুল্লরার বারোমাস্যায় বসন্তকে রমণী দগ্ধ ঋতু হিসেবে অভিহিত করেছেন—
‘সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।
পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে ॥’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু বর্ষা হলেও বসন্তের ছোয়া পাওয়া যায় তাঁর অজস্র গানে, কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের মোট ২ হাজার ২৩২টি গানের মধ্যে প্রকৃতি পর্বের গান আছে ২৮৩টি। এর মধ্যে বসন্ত পর্যায়ের গানের সংখ্যা ৯৮টি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্তের গানে লিখেছেন,
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে ॥
বসন্তকে তিনি প্রকৃতি ও প্রেমের ঋতু হিসেবে বর্ণনার পাশাপাশি বসন্তে দুঃখিনী নারীর আবেঘন প্রকাশ পাওয়া যায়Ñ
‘সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখী জনে যেন দেখিতে না পায়
তারা দেখেও দেখে না
তারা বুঝেও বোঝে না
তারা ফিরেও না চায়
আহা, আজি এ বসন্তে...’
বসন্তের দিনে বিদ্রোহী কবির মনে পড়ে হারানো মানবীকে! যার সাথে দেখা হয়েছিল এই বসন্তে...
‘বইছে আবার চৈতি হাওয়া গুঞ্জে ওঠা মন,
পেয়েছিলেম এম্নি হাওয়ার তোমার পরশন।’
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন- ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।
নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতায় বসন্তকে কেন্দ্র করে লিখেছেন-
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসংগীতে যত আছে
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আখি
তবুও ফুটেছে জবা- দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৪০০ সাল কবিতায় লিখেছেন-
আজি নব বসন্তের প্রভাত বেলায়
গান হয়ে মাতিয়াছ আমাদের যৌবন মেলায়।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু ‘হেমন্ত’ হলেও তাঁর অসংখ্য কবিতায় পাওয়া যায় বসন্তকে। তিনি তাঁর ‘সবিতা’ কবিতায় বসন্তকে তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে:
ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;’
বসন্তকে নিয়ে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি আছে বেদনা। কবি সুফিয়া কামালের ক্লান্ত-শ্রান্ত প্রিয় হারানো বেদনাতুর মনে বসন্ত সমীরণ জাগাতে পারে না চঞ্চলতা। ‘তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে?-শুনি নাই, রাখিনি সন্ধান।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে বসন্ত ঋতুতে প্রকৃতি, প্রেম ও মানব মনের সম্মিলিত বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে হয়ে আছে অনন্য, অনতিক্রম্য!
‘আসে বসন্ত। ...বসন্ত এমনি ঋতু এই সময় বুঝি সকলের মনে প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। ...যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। ‘
ফুল ফুটবার পুলকিত দিন বসন্ত। বন-বনান্তে, কাননে কাননে পরিজাতের রঙের কোলাহল আর বর্ণাঢ্য সমারোহ। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাই গেয়ে ওঠেন,
‘বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত বাতাসে,
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ,
আমার বাড়ি আসে।
সই গো বসন্ত বাতাসে!’
ফাল্গুন আমাদের শুধু মোহিত করে না। ফাল্গুন আমাদের দিয়েছে প্রতিবাদের শক্তি। বসন্তের মাঝে লুকিয়ে থাকে জাগরণের ধ্বনিও। ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বাংলার ছাত্র যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে অকাতরে বিলিয়েছে আপন প্রাণ।
বসন্তকে কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান দেখেছেন প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা  কালজয়ী  উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’-এ পাওয়া যায় বাঙালির নতুন করে জেগে উঠবার আখ্যান।
‘রসুল চিৎকার করে উঠলো, জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না।
আর একজন বললো, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’
অতুল প্রসাদ সেনের ভাষায়-
আইল আজি বসন্ত মরি মরি কুসুমে রঞ্জিত কুঞ্জ মঞ্জরি।
 বসন্তকাল বৃহৎ বৃহৎ কল্পনা ও সুন্দর স্বপ্নের জন্ম দেয়। জীবনকে রঙিন ও মধুর করে ভাবতে শিখায়। এ মুহূর্তে মানব মনে জাগে কত কথা, কত গান ‘আজি এ বসন্ত সমীরণে/কত কথা মোর মনে পড়ে।’ দখিনা বাতাসের মৃদুদোলা দেহ ও মনের ক্লান্তি জুড়ায়। বসন্তের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আমাদের প্রাণকে চঞ্চল করে তোলে।

×