ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১

পাহাড়ি নারীর সংগ্রাম

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:২১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পাহাড়ি নারীর সংগ্রাম

সমাজের সমসংখ্যক নারীর সংগ্রামী ইতিবৃত্ত সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই। শারীরিকভাবে কোমল ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারীরা শাসন-শোষণ আর বঞ্চনার কঠিন নিগড় থেকে কখনো মুক্তি না পাওয়াও সমাজ কাঠামোর লাগাতার দুর্ভোগ। সৃষ্টির সেরা মানুষ তাদের লিঙ্গ বৈষম্যের ফারাকে নিপতিত হয় সেই প্রথম থেকেই নারী আর পুরুষে। যা অতি আদিম কৌম ব্যবস্থা থেকে। বর্তমানে সভ্যতা শিখরে পরম উৎকর্ষের বাতাবরণেও তার কোনো ব্যত্যয় আজ অবধি দৃশ্যমান নয়। উন্নয়ন কর্ম যুগের পরম শুভলগ্নেও বলা হয় নারী-পুরুষের ফারাক তাও নাকি অবধারিত অগ্রযাত্রার কালো চিহ্ন। সময়, দেশ আর নবযুগের হাওয়ায় ব্যতিক্রমী অনেক কিছু দৃশ্যমান হলেও নারী-পুরুষের বিদ্যমান তারতম্যের কোনো ব্যত্যয় লক্ষণীয় নয়। তাই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মধ্য গগনেও আওয়াজ তুলতে হচ্ছে সমঅধিকার, শ্রমমজুরিতে প্রাপ্য বেতন আজও বিসদৃশ্যভাবে কাঁটার মতো বিঁধে আছে নারী-পুরুষের বিভাজন-বিভক্তিতে।
বিশ্বর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা সুজলা, সুফলা উর্বর পলিমাটির অঞ্চল। কবি গুরু বলেন, বীজ মাত্রই এখানে সোনা ফলে। আর নদী ও নারীর মিলিত কলতানে আবহমান বাংলার যে রূপ মাধুর্য তা সত্যিই জননী বঙ্গভূমির এক শাশ^ত বৈভব। প্রযুক্তির চলমান উন্নয়ন ধারায় বিজ্ঞান সর্বত্রগামী হলেও কিছু অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্য চিরায়ত বাংলা পাহাড়-পর্বতেরও এক নির্মল পাদদেশের অনন্য লীলাক্ষেত্র। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের যে আদি নিবাস সেটাও যেন বাংলার হরেক বৈচিত্র্যের শাশ^ত বরমাল্য। শুরুটা করি নারীদের জীবনাচরণ, সংগ্রামী অভিযাত্রা সঙ্গে পুরানো ও নব্য সংস্কৃতির মিলন দ্যোতনায় পাহাড়ি নারীদের জীবনগাঁথা সত্যিই লড়াকু এক যাত্রা। বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ আর চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসীদের নিত্যজীবন সমতলভূমির মানুষের মতো তত নিরাপদ কিংবা নির্বিঘ্ন হয় না সমতল কিংবা পাহাড়ি যে কোনো সমাজের নারীরা হরেক সামাজিক অপসংস্কারে তাদের যাপিত জীবনকে স্বস্তিদায়ক মাত্রায় নিতেই পারে না। সেখানে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা কতখানি তাদের নিত্যজীবন নিষ্কণ্টক থাকে তাও হরেক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসছে। কঠিন, দুর্গম, পার্বত্য এলাকাসমূহ অনেকটাই আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া থেকেও দূরে থাকে। আর মাতৃতান্ত্রিক পাহাড়ি পরিবারগুলো নারী প্রধান নেতৃত্বের সম্পর্কের নিগড়ে বাধা। ঐতিহ্যিক এমন সব পাহাড়ি নারী তাদের জাতিগত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক বরমাল্যে যুগ থেকে যুগান্তর পাড়ি দেওয়া সেটাও যেন নৃতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতার আর এক পর্যায় তো বটেই। আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ আয়তনে তত বেশি নয়। কিন্তু নানামাত্রিক দুঃসাহসিক অভিযাত্রার সংগ্রামী ইতিবৃত্ত একেবারে নজরকাড়া। আমরা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ বাদ দিলেও সমসংখ্যক নারী বরাবরই তাদের অধিকার আর স্বাধীনতা অর্জনে কত সংগ্রামী ইতিবৃত্তের সরাসরি অংশীদার তাও পর্বতের নারীদের অনন্য, অদম্য যাত্রাপথ। কঠিন লড়াই আর যাপিতজীবনের নানামাত্রিক দুর্ভোগ যাতনার শিকার হতেও হয়েছে নারীদেরই। কিছু সংগ্রাম, যাতনা, কষ্ট মর্মবেদনা যেন নারী সমাজের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বংশপরম্পরায় এক নির্মম বলয়ের ক্ষত চিহ্ন। স্বাধিকার অর্জনের জন্য তাদের যে লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত সেটাও দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এক কঠিন পর্বতের মতোই শক্ত প্রাচীর। তার মধ্যে আছে সার্বজনীন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাঙালি-পাহাড়ি নিয়ত বিবদমান গোষ্ঠীর হরেক দুর্যোগ, দুর্বিনীত অসহযোগ কার্যক্রম থেকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়াও যেন পর্বতবাসীদের আর এক পিচ্ছিল যাত্রাপথ। তবে পাহাড়ি কিছু পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। যেমন ময়মনসিংহের গারো পাহাড়, সিলেটের খাসিয়া পুঞ্জি এসব পর্বতের জীবন আর সামাজিক বলয়ে নারীর প্রাধান্য যুগা-যুগান্তরের নির্মাল্য। শুধু কি তাই? সমতল ভূমি থেকে আলাদা পাহাড়ি নারীদের পরিশ্রম করার শক্তি যেন যুগ যুগের পরম এক আশীর্বাদ। কাপড়ের মধ্যে কোলের দুধের শিশু জড়িয়ে তাকে পিঠে বেঁধে যে মাত্রা চাষাবাদ থেকে পারিবারিক সামাজিক সব দায়-দায়িত্ব সম্পন্ন করেন জন্মদাত্রী মা তাও লড়াই-বিপ্লবের দ্বৈরথ তো বটেই। সেখানে কত না পাবার তিক্ততা, বঞ্চনার অপঘাত সেটাও আর এক দগদগে ক্ষত চিহ্ন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ি নারীরা স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাও তাদের নিত্য জীবন্ত বৃত্তান্তের অবিচ্ছেদ্য পালাক্রমের চলমান সংঘর্ষ বলাই যেতে পারে। আয়তনে পার্বত্য এলাকা বৃহদাকার না হওয়ায় যাতায়াতের সীমা সকলের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। যা নারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা হিসেবেও পরিগণিত হয়। একদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নমাত্রার বৈপ্লবিক অভিগমন। পাহাড়, পর্বতের নারীরা স্বাধীনচেতা, দুঃসাহসিক, আত্মপ্রত্যয়ী এবং বিপরীত স্রোতকে মোকাবিলা করার অদম্য এক জাতিসত্তা তো বটেই। যা সমতল ভূমির নারীদের সঙ্গে  খুব একটা যায়ও না। সহযোদ্ধা পুরুষ সহকর্মীকেও নিজেদের মতো ভাবতে পছন্দ করে। বরং সমানে সমানে একই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ সংগ্রামী পাহাড়ি কন্যারা সত্যিই এক দুর্দমনীয় শক্তিময়তায় সন্তান ধারণ থেকে পালনই শুধু নয় নিত্যজীবনের গতি প্রবাহে লড়াকু অভিগমনের নির্ভীক পাহাড়ি কন্যার জীবনের ইতিবৃত্ত। সত্যিই সংগ্রামী, বিপ্লবী মন্তস্তত্ত্বে উদ্দীপ্ত, নারীর সুললিত কোমল আধারের অনন্য রূপ শৌর্যে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার লড়াকু নারী সমাজ সারাদেশের বঙ্গললনাদের আর এক চমৎকার অভিব্যক্তির পরম নিদর্শন।

×