![বইমেলায় নারী লেখক ও বিক্রেতা বইমেলায় নারী লেখক ও বিক্রেতা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/1-2502131114.jpg)
অমর একুশে গ্রন্থমেলা তার ঐতিহাসিক ও নান্দনিক কর্মযোগে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ক্রেতা, বিক্রেতা ও দর্শকের ভিড়ে আকর্ষণীয় এই বইমেলায় নারীদের সরব উপস্থিতি পরিস্থিতির অনিবার্যতা। নারী লেখকের সরব পদচারণা যেমন আছে পাশাপাশি বিক্রেতা হিসেবে আর এক চমৎকার দৃশ্যও দৃষ্টিনন্দন। তবে এবার নারী লেখকরা আলাদা কোনো স্টলে বই বিক্রি করছেন না। যা গত বছরের বইমেলাকে ভিন্নমাত্রা দেয়। তবে সৃষ্টিশীল দ্যোতনায় নারী রচয়িতার সৃজন সম্ভার মেলার অন্যতম আকর্ষণও বটে। খালেদা সালাউদ্দিন লিখেছেন ‘আধুনিক সমাজ ও বাংলাদেশের নারী।’ চমৎকারভাবে উৎসর্গ করেছেন দেশের অগণিত নিপীড়িত নারীকে যারা নিয়ত জীবন সংগ্রামে লাঞ্ছিত আর পদদলিত। যেখানে নারীর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের রূপরেখা দিতে গিয়ে ভালো-মন্দ দুটোই সমানভাবে উঠে এসেছে। নারী শিক্ষা প্রসারিত হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে। হরেক ব্যতিক্রমী পেশায় তাদের সময়োপযোগী অভিগমন দুরন্ত এবং অবারিতও বটে। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নানামাত্রিক দুর্যোগ, অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি না পাওয়াও যেন নতুন কালের ক্ষতচিহ্ন। ক্ষত-বিক্ষত নির্যাতনে কাতর নারীদের জীবন লড়াই আজও সমাজের আনাচে-কানাচে দৃশ্যমানভাবে ছড়ানো, ছিটানো। অদৃশ্য কোনো বিষবাষ্প নয় বরং নিয়তই উদ্ধত, উন্মত্ত প্রতিকূল পরিবেশের নৃশংস ছোবল। বরাবরের মতো এবারও নারী গ্রন্থ রচয়িতাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে পাঠক সমাজ। যা সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে চিরস্থায়ী মর্মবেদনার নিত্যনতুন আঁচড়। যা নিম্ন থেকে মধ্য এমন কি উচ্চবিত্ত সামাজিক পরিমণ্ডলের আধুনিকতার নতুন পরিবেশের ওপর বিষদৃশ্য এক বিষফোঁড়া। যা দগদগে ঘায়ের মতো জীবনভর যন্ত্রণাকাতর মর্মস্পর্শী বাতাবরণ, যা থেকে আজও সমসংখ্যকের মুক্তি মেলেনি। সামনেও যা সুদূর পরাহত। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্য গগনেও নারী নিগৃহ সেই মান্ধাতা আমলের ধারাবাহিক নির্যাতনের আর এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। প্রাচ্যের ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীর কত সুসংবদ্ধ ঐতিহ্যিক সম্ভার আর পথপরিক্রমা রয়েছে। পাশাপাশি অন্যায়, অবিচার, অপঘাতের করুণ চিত্রও নানামাত্রিক দুর্ভোগের নগ্নতা। যা সমাজ আর পরিবেশের নিতান্ত দগ্ধতার নৃশংস বাতাবরণ।
সালমা খান লিখেছেন ‘একুশ শতকে বাংলাদেশের নারী’। সেখানে উৎপাদন ব্যবস্থায় নারী সক্রিয় অংশ নেওয়াই শুধু নয় উঠে এসেছে ঐতিহাসিক অবদানও। যা সৃষ্টিশীলও নতুন বাংলাদেশ গঠনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে বিরাম- বিরতিহীনভাবে। সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নারীর যথার্থ ক্ষমতায়ন কাগজে কলমে নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিটি কর্মযোগও। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে শস্য উৎপাদনে নারীর যে সুদীর্ঘ যাত্রাপথ তা দেশের উর্বরা শক্তির আর এক ফলন দক্ষতা তো বটেই। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয় কয়েক শতাব্দী ধরেই এ অঞ্চলের নারীরা এক গতিশীল জীবনাচরণে অভ্যস্ত ছিল যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গেও ছিল তার সুনিবিড় কর্মদ্যোতনা।
ইতিহাস স্বীকার করে কৃষি সভ্যতার বীজ বপনে নারীর অবদান। ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী। কারণ সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই পুরুষরা বাইরে গিয়ে বন বনান্তরে প্রবেশ করে ফলমূল এসব কুড়িয়ে আনত। সেটাই ছিল উৎপাদন পূর্ববর্তী আদিম মানুষের খাদ্য সংস্থান। কিন্তু কৃষি সভ্যতার বীজ বপনে নারীর দুর্দন্ত অভিগমন ইতিহাসের বরমাল্য। কারণ ফলমূলের বীজ রোপণ করত গৃহবাসী নারীরাই। যারা ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বীজ ফেলে দিত এখানে সেখানে। অবাককাণ্ড সেখান থেকে চারা জোগানো পরে বৃহৎ গাছে পরিণত হওয়া সৃষ্টির আর এক রহস্য তো বটেই। যা বিধাতা দিয়েছেন নাকি নারীকে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- সৃষ্টির আদি যন্ত্রণা নারীর দেহ আর মনে। তেমন বেদনা সহ্য করার শক্তিও নারীর শরীরে। লেখিকা সালমা খান নারীর সৃষ্টি রহস্য বিধৃত করতে গিয়ে জীবনাচরণে বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডে নারীর দৃশ্যমান ভূমিকাকে ইতিহাসের বরমাল্যে নিয়ে গেছেন।
শুধু কি জীবনাচরণ? সংস্কৃতি আর সময়ের পালাক্রমে মানুষের নিত্য কর্মপ্রবাহে নারী সমাজ যে কি অবর্ণনীয় ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তা আর আড়ালে, আবডালে থাকেও না।
দৃশ্যমান এক সমাজ-সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রতিদিনের দুরন্ত পালাক্রম। সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নারীর চিরন্তন প্রবহমান গতি সামাজিক বলয়ের অতীত বর্তমান আর আগামীর ধারাবাহিক তথ্যচিত্র। মহিলা সাহিত্যিকদের ধারাবাহিক রচনাশৈলে নারী পাঠক তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক অভিযোজনে নতুন সময়ের অনন্য আহ্বান তো বটেই। যা শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্ন থেকে আজ অবধি। প্রথমে ধীর পায়ে সচেতন সাবধানতার অনুপ্রবেশ, পরবর্তীতে সেখানে গতিশীল আবহ তৈরি হওয়া সমাজ-সংস্কৃতিরই নতুন ধারা। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলা যায় সমসংখ্যক নারী সমান তালে পুরুষের সঙ্গে এগিয়ে চলাই শুধু নয় প্রতিষ্ঠা পেতেও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। শুরুটা অত সহজ কখনোই ছিল না। পদে পদে বাধা, হোঁচট খেতে হয়েছে। সেখান থেকে সুদীপ্ত মনোবলে নিজেকে তৈরি করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাও বিগত সময়ের রুদ্ধতার জাল। যা ভেদ করে নারীদের গতিশীল পদচারণা সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণকে নির্দিষ্ট পথে চালিতও করছে। বইমেলায় নারী লেখকদের রচনায় শুধু যে নারীর সাবলীল অভিগমন কিংবা অত্যাচার-নিপীড়ন চিত্রিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। উত্তরণের যাত্রাপথও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত বছরের বইমেলায় নারী লেখকদের জন্য আলাদা স্টল থাকলেও এবার তা দেখা যায়নি। তবে বই বিক্রিতে নারী বিক্রেতার সংখ্যা হাতেগোনার অবস্থায় নেই। তা ছাড়া নারী লেখকের বিচরণ মেলাকে সমৃদ্ধ করেছে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। সৃজনশীল নারী লেখকের অভাবনীয় সৃষ্টি দ্যোতনায় দেশের সমতাভিত্তিক রচয়িতা নির্মাণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সেই গত শতাব্দীর শুরু থেকেই, যা আজ সময়ের গতিতে বাড় বাড়ান্ত অবস্থায়। নারীরা আসলেই সমান তালে এগিয়ে চলতে পিছু হটলে সমতার আদলে সমাজকে ঢেলে সাজানো কঠিন হবে। যা এখনো সংগ্রামী পরিক্রমার অধীন। নারীরা বহু রুদ্ধতার জাল থেকে মুক্তি পেলেও পাহাড়সম প্রাচীর আজও সামালতে হচ্ছে সিংহভাগকে।