![দইমেলার ৩০০ বছর দইমেলার ৩০০ বছর](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/15-2502071336.jpg)
সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তাড়াশে ঐতিহ্যবাহী দইয়ের মেলায় বিক্রির অপেক্ষায় ব্যাপারি
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিনশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী দইয়ের মেলা গত সোমবার সকাল থেকে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। তাড়াশের তৎকালীন জমিদার পরম বৈঞ্চব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দই মেলার প্রচলন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে তৎকালীন পরম বৈঞ্চব জমিদার রাজা রায় বাহাদুর দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। এ ছাড়া জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করা হতো। আর সে থেকেই জমিদার বাড়ির সম্মুখে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী দইমেলা বসত। মেলার দিনগুলোয় এ অঞ্চলের প্রজা সাধারণসহ সবাই অন্তত এক বেলা খাবারের পাতে দইয়ের স্বাদ নিতে পারেন। তখন থেকে প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার দিন পঞ্চমী তিথিতে দইমেলা বসে আসছে। যা জমিদার রাজা রায় বাহাদুর, বনমালী রায়, ক্ষিতীশভূষণ ও রাধিকাভূষণ পর্যন্তও মোটামুটি জাঁকজমক ও জৌলুসপূর্ণ ছিল তাড়াশের দইমেলা। পরবর্তী সময়ে জৌলুস কমে এলেও, প্রতি বছর পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজার দিন তাড়াশে ঐতিহ্যবাহী তিনশ’ বছরের দইয়ের মেলা বসেছে। মেলায় বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর থেকে ঘোষেরা দই এনে মেলায় পসরা বসিয়ে আছে।
কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মেলায় দই বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। মেলায় দই বিক্রি করতে আসা বগুড়ার শেরপুরের দই বিক্রিতা নিমাই ঘোষ জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মেলায় ৫০ মণ দই নিয়ে এসেছি। বিক্রি নাই বললেই চলে। মেলায় দই কিনতে আসা তাড়াশ পৌর এলাকার মুশফিকুর রহিম বলেন, মেলা উপলক্ষে দই, চিড়া মুড়ি মুড়কি কিনে থাকি। কিন্তু সবগুলোর দইয়ের দাম বেশি চাচ্ছে। আগে সরার (দইয়ের পাত্র) আকার ছিল বেশ বড় এখন দেখছি আকারে অনেক ছোট। প্রতি কেজি দই বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা। একই দই গতবছর বিক্রি হতো ১৫০-২০০ টাকায়। মেলায় দই বিক্রেতা জীবন ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুধের দাম, জ্বালানি, শ্রমিক খরচ, দই পাত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দামও বেড়েছে। তবে মেলা এক দিনব্যাপী হলেও চাহিদা থাকার কারণে কোনো ঘোষের দই অবিক্রীত থাকে না। গরমে চিঁড়া, মুড়ি, খই, দই, আম, কলা, দুধ, ক্ষির এতেই যা একটু রস, মিষ্টত্ব আর পরিতৃপ্তি। দই আবহমান সময়কাল ধরে বাঙালির জীবনের প্রতিদিনের খাবার, ভোজনরসিকদের অন্যতম আকর্ষণ। এ সবই ঘটে তাড়াশের দই মেলাকে ঘিরে বাঙালি রসনায় দই জুড়িহীন। শেষ পাতে দই হলে তো কথাই নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে দই পরিবেশন করা হয়ে থাকে। দই থেকেও তৈরি হয় নানা পদ।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দুধ, চিনি, ও জ্বালানির দাম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সরা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। অন্যান্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে বেড়েছে দুধ ও টক দইয়ের দাম। কথিত আছে সবচেয়ে ভালো সুস্বাদু দই তৈরিকারক ঘোষকে জমিদারের পক্ষ থেকে উপঢৌকন প্রদান করার রেওয়াজ ছিল। তবে জমিদার আমল থেকে শুরু হওয়া তাড়াশের দইয়ের মেলা এখনো মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে উৎসব আমেজে বসার বার্ষিক রেওয়াজ এখনো আছে।
দইয়ের মেলায় আসা এ অঞ্চলের দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও ভিন্নতা রয়েছে। যেমন- ক্ষীরসা দই, শাহী দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দই এ রকম হরেক নামে দামের হেরফেরে বিক্রি হয় দই। বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর, চান্দাইকোনা, শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশের দই প্রচুর বেচাকেনা হয়। দইয়ের মেলা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রভাষক সনাতন দাশ বলেন, ‘খাঁটি দুধের সম্ভার খ্যাত সিরাজগঞ্জবাসী প্রাচীন আমল হতেই রসনা বিলাসী আর অতিথি পরায়ন। দইয়ের মেলাটি জেলার আদি ঐতিহ্যের অংশ। ‘সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এ মেলার আয়োজন করা হলেও এখানে হিন্দু মুসলিম সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দই কিনতে আসেন।
মেলায় বিভিন্ন স্বাদের দই কেনার পাশাপাশি মুড়ি-মুড়কি, চিড়া, বাতাসা, কদমাসহ রসনাবিলাসী নানা ধরনের খাবারও দিনভর বিক্রি হয়েছে।
মেলায় বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের ও পেশার নানা বয়সি মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে, অভিভাবকের সঙ্গে শিশুরা, কিশোর কিশোরীরা এসব খাবার কিনতে মেলায় আসে। দই মেলায় আসা এ অঞ্চলের দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও ভিন্নতা রয়েছে। ক্ষীরখাসা দই, শাহী দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দই, রাজাপুরের দই, এনায়েতপুরের দই ইত্যাদি বাহারি নামের দই, দামেও রয়েছে ভিন্নতা। বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জের রাজাপুর, এনায়েতপুর, গুরুদাসপুরের শ্রীপুর, উল্লাপাড়ার ধরইল, চাটমোহরের হান্ডিয়াল ও তাড়াশের দই প্রচুুর পরিমাণে বিক্রি হয়। দই মেলা বসেছিল সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কের হৈমবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও জ্ঞানদায়িনী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। এখানে দই আসে, সিরাজগঞ্জের রাজাপুর, এনায়েতপুর অঞ্চল থেকে।
তাড়াশ সদরের গোপীনাথ সরকার তার স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মেলায়। কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। সরস্বতী পূজা ঘিরে এ মেলার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে দাদা ও বাবার সঙ্গে মেলায় এসেছি। এখন আমার সঙ্গে স্ত্রী ও মেয়ে এসেছে।’ ঐতিহ্যের এ ধারা বেঁচে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উপলক্ষে এ মেলা হলেও দই কিনতে আসেন সবাই। প্রতিবারের মতো এবারও পরিবারের জন্য দই কিনতে এসেছেন তিনি। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শামীম হোসেন। তিনিও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দই মেলায়। ছেলের পছন্দের দই কিনবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্যের এ মেলায় সুযোগ পেলেই আসি।’
বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ও
শহিদুল ইসলাম, তাড়াশ