গ্রামের পল্লীবধূ নারীরা ফুলচাষে এগিয়ে যাচ্ছে। তাও আবার শীতপ্রধান এলাকার টিউলিপ ফুল! আশ্চর্য হওয়ারও কিছুই নেই। ২০২২ সালে তেঁতুলিয়ায় প্রথমবারের মতো পাইলট প্রকল্প হিসেবে উপজেলার শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে টিউলিপ ফুল চাষ করেছিল ইএসডিও। পরীক্ষামূলক চাষের পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় বাণিজ্যিক চাষেও সফলতা পাওয়া যায়। তাই বাণিজ্যিকভাবে চতুর্থবারের মতো এবারও দেশের সর্বউত্তরের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়া ও শারিয়ালজোত গ্রামের ১৩ নারী উদ্যোক্তা টিউলিপ ফুল উৎপাদন করে ফুলের জগতে অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছেন। প্রায় তিন বিঘা জমিতে ৯ প্রজাতির ২০ হাজার বাল্ব রোপণ করা হয়।
এই তেরোজন পল্লীবধূ হলো মোছাঃ মুক্তা পারভীন, মোছাঃ বীনা বেগম, মোছাঃ রইসুন বেগম, মোছাঃ মোর্শেদা বেগম, মোছাঃ আনোয়ারা বেগম, মোছাঃ সুমি আক্তার, মোছাঃ আয়েশা বেগম, মোছাঃ মনোয়ারা বেগম, মোছাঃ শায়েকা সুলতানা সূর্বণা, মোছাঃ বুলবুলি বেগম, মোছাঃ রশিদা বেগম, মোছাঃ মনোয়ারা খাতুন ও মোছাঃ সেলিনা আক্তার।
নারী উদ্যোক্তা আয়শা বেগম বলেন, ওপারে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এপারে আমরা প্রান্তিক নারীরা ফুটেয়েছি টিউলিপ। পর্যটকরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তেঁতুলিয়া আসে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত দেখতে। এখন তারা কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে টিউলিপ ফুলের বাগানও দেখতে পাচ্ছেন। শুধু অর্থ নয়, ফুল চাষ আনন্দও দেয়। তিনি জানান, এবার সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে পরের বছর আরও বেশি করে টিউলিপ চাষ করব। সরেজমিনে দেখা যায় টিউলিপ বাগানে প্রবেশ করার জন্য টিকিট কাটতে হয় প্রতিজন ৫০ টাকা ও এক একটি টিউলিপ ফুল কিনতে লাগে ১৫০ টাকা করে।
এদিকে বাগান পরিদর্শনে আসা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, তেঁতুলিয়ার মাটিতে ভিনদেশী ফুল টিউলিপ চাষ একটি ভিন্ন উদ্যোগ। খুব ভালো লাগছে এখানে এসে। আমি মনে করি, টিউলিপ ফুল চাষে যেমন কাজের সুযোগ পাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা, তেমনি সাবলম্বী হচ্ছেন তারা।
জানা গেল. ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তেঁতুলিয়ার টিউলিপ বাগান পরিদর্শন করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসান ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডাচ নাগরিক আর্নো হ্যামেলিয়ার্স। বাংলাদেশের মতো দেশে সীমান্ত অঞ্চলে এ রকম নেদারল্যান্ডসের নান্দনিক টিউলিপ ফুলের চাষ হতে দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তারা। এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ঋতুরাজ বসন্তে ভালোবাসার সিক্ত হৃদয় রাঙিয়ে দিবে রাজসিক ফুল টিউলিপ। পাশাপাশি অনেকে অমর একুশে পালনে টিউলিপ ফুল দিয়েও ভাষা সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন।
টিউলিপ ফুল ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয় নেদারল্যান্ডসে। টিউলিপকে নিয়েই সেখানে গড়ে উঠেছে শিল্প। তাই দেশটি প্রতিবছর পালন করে টিউলিপ উৎসব। আর তুরস্কের জাতীয় ফুলও এই টিউলিপ। বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ায় ওই গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, টিউলিপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন তেঁতুলিয়ার টিউলিপ রাজ্যে। আগত দর্শনার্থীরা বাহারি রঙের টিউলিপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেলফি ও ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। রাজশ্রী টিউলিপ ছড়াচ্ছে সুবাস ও রাঙাচ্ছে হৃদয়। তৃষিত করছে অগণিত মন। টিউলিপের রূপে মুগ্ধ হয়ে মোবাইলে ধারণ করছেন টিউলিপের চিত্র। আর টিউলিপময় এ ভালোবাসার রং বহুগুণে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোস্যাল নেটওয়ার্কে। এবার নিয়ে ওই গ্রামে চতুর্থবার টিউলিপ চাষ করা হচ্ছে।
প্রান্তিক নারী চাষিদের ফুল চাষে আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোস্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন ইএসডিও। প্রান্তিক নারীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি। এবার ফুল চাষের পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজম হিসেবে বিদেশে শাক-সবজি আবাদ করা হয়েছে। গত তিন বছরে প্রতিবার দুই মাসের সময়ে এই বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুল চাষ করে খরচ বাদে এই নারী উদ্যোক্তারা ৪০ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেছেন। এবার চারার দাম বেশি তাই ফুলের দামও বেশি। গতবারের চেয়ে এবার আয় বেশি করবেন বলে ধারনা করছেন এই নারীরা।
অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। এটি বাগানে কিংবা কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখার জন্য এর আবেদন অনন্য। রোপণের ২১-২২ দিনের মধ্যে চারা গজিয়ে ফুল এসে যায়। পর্যটনে ইকো ট্যুরিজমকে বাস্তবায়নে চার বছর ধরে প্রান্তিক নারীদের হাতে বিদেশী ফুল চাষ করছে ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও)। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ৯টি প্রজাতির বাহারি টিউলিপ ফুল চাষ হচ্ছে। মশারি নেট দিয়ে মুড়ানো একখণ্ড জমিতে বাগানে সারি সারি লাইনে সবুজ পাতার মাঝে টিউলিপ ফুল ফুটেছে।
৯ প্রজাতির টিউলিপের এবারের জাতগুলো হচ্ছে সানি রাজকুমার, পিঙ্ক আর্ডোর, প্যারেড, অক্সফোর্ড, কমলা ভ্যাব বরলশ, ফেরডেক্স, অ্যাপেলডুম, ব্লাশিং এলিট ও মেস্টিক ভ্যান ইউজক। গতবারের জাতগুলো ছিল অ্যান্টার্কটিকা (সাদা), ডেনমার্ক (কমলা ছায়া), লালিবেলা (লাল), ডাচ সূর্যোদয় (হলুদ), স্ট্রং গোল্ড (হলুদ), জান্টুপিঙ্ক (গোলাপি), হোয়াইট মার্ভেল (সাদা), মিস্টিক ভ্যান ইজক (গোলাপি), হ্যাপি জেনারেশন (সাদা লাল শেড) ও গোল্ডেন টিকিট (হলুদ)। এসব টিউলিপের সৌন্দর্যে তেঁতুলিয়া হয়ে উঠবে একখণ্ড নেদারল্যান্ড। পর্যটনে ইকো ট্যুরিজম যুক্ত হওয়ায় নতুনমাত্রা তৈরি হয়েছে।
টিউলিপ চাষি দলের ওই নারীরা জানান, চতুর্থবারের মতো এ অঞ্চলে নেদারল্যান্ডের রাজকীয় টিউলিপ আবাদ শুরু হয়েছে। টিউলিপ চাষ সাফল্যের পর ধারাবাহিকভাবেই প্রতি বছর এখন ভারি শীত মৌসুমে এ ফুলের আবাদ করে আসছি আমরা। গত তিন বছর ধরে আমাদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করে যাচ্ছে ইএসডিও সংস্থাটি। এবার ফুল চাষের পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজম হিসেবে বিদেশে শাক-সবজি আবাদ করেছি।
ইএসডিওর পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার বলেন, আমরা খুব আনন্দিত যে চতুর্থবারের মতো তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়ায় টিউলিপ চাষ শুরু করতে পেরেছি। আমরা টিউলিপের বীজ সরবরাহ করেছি। নারী ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে এ অঞ্চলের প্রান্তিক নারীদের সহযোগিতায় এ বছরও টিউলিপ আবাদ করেছি। আসলে এ ফুল ফোটাতে এখানকার প্রান্তিক নারীরা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের হাতে ফোটা টিউলিপের নজরকাড়া সৌন্দর্যে পর্যটকদের মোহিত করছে, আকৃষ্ট করছে। সবাই টিউলিপ দেখে মুগ্ধ হোক। ভ্রমণে হোক, বনভোজনে হোক সবাই যাতে এ ফুল দেখতে পারে তাহলে আমাদের উদ্যোগ সার্থক হবে।