ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে নারী

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা আন্দোলনে নারী

ঢাকার রাজপথ রক্তে রাঙিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পাকিস্তানকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল নজরকাড়া। বিশেষ করে সে সময় যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মায়ের ভাষার সম্ভ্রম হারানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। অন্যায়, অপবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সংগ্রামী নারী আজও ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৫২ সালের সে সময়ে নারীদের ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া এক কঠিন বেড়াজাল ছিল। তেমন আটকানো আর পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে নারীদের ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় দর্পভরে অনুপ্রবেশ ইতিহাসের মাইলফলক। যা এখনো ঐতিহ্যিক ধারাকে মহীয়ান করে রেখেছে। সবার আগে বলতেই হবে শিক্ষাই প্রধান সূচক যা অর্জন করে নারীদের আলোকিত জগতে পা রাখতে পেছনে তাকাতে হয়নি। তাই সংকটাপন্ন মাতৃভাষাকে সুরক্ষা দিতে লড়াকু নারীরা তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে বীরদর্পে এগিয়েও আসেন। এখানে উল্লেখযোগ্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীরাই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে ইতিহাসের অংশীদার হয়ে আছেন। একুশের চেতনায় উন্নত শিরে যাঁরা ভাষাকে আপন মর্যাদায় রাখতে মরিয়া হয়ে আন্দোলনে অংশ নেন সেখানে অনেকের নাম খুঁজেও পাওয়া যায়নি। যে কয়জনের নাম সামনে এসেছে তাদের নিয়েই এই আলোচনা। রওশন আরা বাচ্চু- সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় জন্ম নেয়া এই ভাষা সংগ্রামী ১৯৩২ সালে পৃথিবীর আলো দেখেন। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ২০ বছরের এক উদ্দীপ্ত তরুণী। তারুণ্যেও অপার মহিমায় তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ষড়যন্ত্রকারী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। ’৪৭-এর অনাকাক্সিক্ষত দেশ বিভাগের সময় তিনি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এই সম্ভাবনাময় নারী ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। সে সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে তাঁর সংগ্রামী পদচারণা আজও ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রওশন আরা বাচ্চুও অংশ নেন। এখানে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে তিনি আহত হন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের মর্যাদায় তাঁর বহুল কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। মমতাজ বেগম- ১৯১৬ সালে জন্ম নেয়া কল্যাণী রানী কলকাতায় থাকাকালেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মমতাজ বেগম নামে নিজের নতুন পরিচয় তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনে ৩৬ বছর বয়স্ক এই মমতাজ বেগম তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকায় আজও অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আছেন। ১৯৫২ সালে নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর সংগ্রামী ও জোরালো ভূমিকায় পাকিস্তানি পুলিশ তাকে শেষমেশ আটকও করে। তবে কোনোভাবে বশ্যতা স্বীকার করেননি। নারী হিসেবে মুচলেকা দেয়ার বিনিময়ে তিনি মুক্তি পেতে পারতেন। দুঃসাহসী এই ভাষা সংগ্রামী মোটেও তা করেননি। মুক্তি নয়, বরং জেলে অবরুদ্ধ থেকেই তিনি তাঁর কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন নির্দ্বধায়, নির্বিঘ্নে। আর এই লড়াকু মানস চেতনায় আজও ইতিহাসের অনন্য নায়কের মর্যাদায়। সুফিয়া আহম্মদ- জাতীয় অধ্যাপিকা সুফিয়া আহম্মদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থী হিসেবেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
’৫২ সালের এই অকুতোভয় সংগ্রামে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সামনের সারিতে ছিলেন এই ভাষাসৈনিক। দুর্বার প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশের ছড়ানো কাঁদুনে গ্যাসে তিনি আহত হন। পরবর্তীতে পুলিশের লাঠির আঘাত থেকেও তিনি রেহাই পাননি। শারীরিকভাবে দুর্বল নারীরা কি মাত্রায় তাদের পুরুষ সহযোদ্ধার পাশে থেকে অকাতরে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন- সেটাও ভাষা আন্দোলনের মহিমান্বিত অধ্যায়। চলমান ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সব সময় থাকা এই নারী মায়ের ভাষাকে যথার্থ মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে যা করার সবটাই করতে অকুণ্ঠিত ছিলেন। ড. শাফিয়া খাতুন- ১৯৩১ সালে জন্ম নেয়া এই ভাষাসৈনিক ’৫২ সালে ২১ বছরের এক উদীয়মান তরুণী। তারুণ্যেও প্রবল উদ্যোমে শিহরিত হওয়া এই নারী ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনো দিকে ফিরেও তাকাননি। ১৯৫১-৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে সময় তিনি মহিলা ছাত্র ইউনিয়নের ভিপির পদ অলঙ্কৃত করেন। আবাসিক ছাত্রী নিবাস ও চামেলী হাউসের ছাত্রীদের নিয়ে ভাষা আন্দোলনে যে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা রাখেন সেটা তাঁর দুর্জয় সাহসের অগ্নিস্ফুরণ। ১৯৫২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার আহ্বান আসে ড. শাফিয়া খাতুনের পক্ষ থেকে।
পরবর্তীতে তিনি সরকারী পদমর্যাদায় অনেক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে তাঁর সম্মান অক্ষুণ্ন রাখেন। হামিদা রহমান- ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ জিন্নাহ কর্তৃক ঘোষিত উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে হামিদা রহমানের সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠ আজও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য। শুধু তাই নয় সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলও তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে যায়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তাঁর জোরালো কণ্ঠের আবেদনে।
পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তাঁকে মাঝে মধ্যে পুরুষের পোশাকও পরিধান করতে হয়। অর্থাৎ নারীরা তখন উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করেছে লড়াকু চেতনায় বিভিন্ন সংগ্রামী অভিযাত্রায় পুরুষের পাশে থেকেছেন। এ ছাড়া ড. হালিমা খাতুন, বেগম সুফিয়া কামাল ড. সানজিদা খাতুন, নূরজাহান বেগম, মিসেস কাজি মোতাহার হোসেনসহ বহু নারীর সংগ্রামী পথপরিক্রমায় ভাষা আন্দোলন তার গতিধারা সমুন্নত রাখে।

×