ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২২:৪১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

.

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি ...। বছর পেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এ মাসেই ভাষার অধিকার আদায়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন ভাষাশহীদেরা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অমূল্য প্রাণ সঁপে দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহীদেরা। তাঁদের প্রাণের বিনিময়েই চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল ভাষা আন্দোলন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি সৃষ্টি করেছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার নতুন ইতিহাস। পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বহ্নিশিখা।  ইতিহাসের  বাঁক ফেরানো সেই রক্তঝরা পথরেখাতেই একে একে এসেছে ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বিজয় অর্জন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা। এমনকি নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে মাতৃভাষার সংগ্রাম। সেই সুবাদে আজও বাঙালির অস্তিত্বের  সংকটে-সংগ্রামে আলোকরেখা হয়ে সামনে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি।    
ফেব্রুয়ারি মানেই অঙ্গীকারের মাস, প্রত্যয়বদ্ধ হবার মাস। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমাজে, রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শপথ নেওয়ার মাস ফেব্রুয়ারি। তবে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পেরুলেও অফিস-আদালত.  শিক্ষাক্ষেত্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডসহ সর্বস্তরে বাংলাকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসটি পূরণ হয়নি। রয়ে গেছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আক্ষেপ। তাই এবারও থাকছে যাপিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার সেই অঙ্গীকার।
প্রতিবছরই ভাষার মাসকে ঘিরে থাকে নানা আয়োজন। তেমনই এক আয়োজন বাঙালির মননগত  উৎকর্ষের প্রতীক এবং সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব অমর একুশে বইমেলা। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। আজ শনিবার মাসব্যাপী মেলা উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে সর্বোচ্চসংখ্যক ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি স্টল থাকবে। গত বছর  প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি। এবার মেলায় ৩৭টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। লিটল ম্যাগাজিন চত্বর থাকছে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুচত্বরে থাকবে ৭৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।  
এবার বলি একুশের সেই দ্রোহকালের কথা। মূলত বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সূচনাটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। সাতচল্লিশের ১৭ মে হায়দারাবাদে এক উর্দু সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ঘোষণা দেন, ‘পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু’। তার সঙ্গে সুর মেলান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদে ২৯ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আজাদ’ পত্রিকায় বলেন, বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তবে দুইটি রাষ্ট্রভাষা করা গেলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যায়।
এমন বাস্তবতায় পাকিস্তান গঠনের পর থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও প্রাদেশিক সরকারের কাজ চালাবার মাধ্যম রূপে মেনে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে সমগ্র পাকিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষায় উর্দুকে এক বছরের জন্য বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, আব্দুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান, এস আহমদ প্রমুখ। রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমদ।

×