শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত-নির্বিত্তই নয় বরং মর্যাদার লড়াইয়ে নামতে হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই। সেখানে শারীরিকভাবে কোমল আর দুর্বল অংশ হিসেবে সমসংখ্যক নারীর প্রশ্ন চলে আসে সবার আগে। সৃষ্টির ঊষাকাল থেকে শ্রমই মূল নির্ণায়ক শক্তি যা সভ্যতার ক্রমবিকাশে অবিস্মরণীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। উৎপাদন কিংবা সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে শ্রমকেই সবার আগে বিবেচনায় এনেছেন বিজ্ঞজনরা। প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ আর শিল্প প্রযুক্তির আধুনিক বলয় অবধি। প্রযুক্তি ইতিহাসে গতি এনেছে ঠিকই। কিন্তু সৃষ্টির সেরা মানুষের মূল্যবান শ্রমযোগ ছাড়া উৎপাদনের সার্বিক হাতিয়ারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। বস্তুবাদী সমাজবিজ্ঞানী এঙ্গেলস তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বানর হতে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকায়’ উল্লেখ করেন কিভাবে চতুষ্পায়ী বানর সামনের দু’পা তুলে গাছের ফলমূল পেড়ে ভক্ষণ করত। আর সেই তো প্রাগৈতিহাসিক যুগের শ্রম বিবর্তনের ধারায় বন্য মানুষ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানব তৈরির সভ্যতা সূর্যের উদয়। সেখানে শুধু একটাই বৈষম্য তা হলো নারী-পুরুষের বিভেদ। ধারণা করা হয় সভ্যতা সৃষ্টির মূল ধারাবাহিকতায় নারী সমাজের প্রাধান্যই স্বীকৃত বলে আলোচিত। তবে আদিম সাম্যবাদী সমাজের দীর্ঘকালীন স্থায়িত্বে শুধুু একটাই তারতম্য ছিল যা নারী-পুরুষ প্রভেদ। সভ্যতার ক্রমবিকাশে বিভিন্ন সমাজ কাঠামো বিকাশ লাভ করলেও একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও নারী-পুরুষ বৈষম্যই মাথা চাড়া দেওয়া। যা কোনোভাবেই থামানো যায়নি। তবে শুধু নারী-পুরুষের বিভাজনেই সমাজ থেমে থাকেনি। আরও কত ফারাক সমাজ-সংস্কারের মর্মমূলে গেঁথে গেছে। তাও যেন এক বঞ্চনার ইতিবৃত্ত। সেখানে নারী-পুরুষের শ্রমমূল্যেও তৈরি হয়েছে ব্যবধানের প্রাচীর। একজন পুরুষ সহকর্মী দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রম বিনিয়োগ করে অর্জন করে ৫০০ টাকা। সেখানে নিকটতম নারী শ্রমিক একই শ্রম ঘণ্টা নিয়ে পায় মাত্র ৩৫০ টাকা। শ্রম সময় এবং ধরনের মধ্যে বিন্দুমাত্র তারতম্য থাকে না। কিন্তু মজুরির বেলায় কেন এই হতাশা আর প্রাপ্য অর্জন থেকে বঞ্চনা? তার সুরাহা আজ অবধি না মেলাও নারী শ্রমিকদের কর্মযোগের প্রতি অবহেলা, নিয়মবহির্ভূত অন্যায়-অবিচার। তার কোনো হিতকর অবস্থা দৃশ্যমান না হওয়াও পরিস্থিতির অসাম্য-বৈষম্যের পাহাড়সম অচলায়তন। এমনিতেই নারী-পুরুষ কোনো শ্রমিকই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অপদৃশ্য যুগ- যুগান্তরের শোষক শ্রেণির চরম দুর্বৃত্তায়ন। যার কারণে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক শ্রম ও নারী দিবসের তাৎপর্য আজও সংশ্লিষ্টরা বয়ে বেড়াচ্ছে। যথার্থ সমাধান অদৃশ্যের কঠিন নিগড়ে। তাই আন্দোলন আর সভা সমিতিতে সোচ্চার হওয়া ছাড়া যথার্থ কর্মযোগ নিয়তই ধরাছোঁয়ার অতীত। শুধু কি তা-ই? এমন ক্রমাগত বঞ্চনার ইতিবৃত্ত সংশ্লিষ্টদের সেভাবে চিন্তিতও করে না। আসলে নারী শ্রমিকরা জানেই না তাদের অধিকারের মাত্রা। তা ছাড়া আইনি কর্মযোগ নিয়েও সেভাবে মাথাটি ঘামায় না পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে নারী- পুরুষের আদৌ বিন্দুমাত্র প্রভেদ নেই। সেখানে মূলত লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্যই করা হয়নি। একজন শারীরিকভাবে শ্রম, বিনিয়োগকারী যোদ্ধা তার শ্রম ঘণ্টা আর ধরন নিয়েই মজুরি পাবে এমনটাই আইনে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সমাজের উচ্চাসনে বসা মালিক গোষ্ঠী কতভাবে যে নিরীহ শ্রমিকদের তার যথার্থ পাওনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তা নিজেরাও জানে না। মাঝে মধ্যে অস্থিরতা আর উদ্বিগ্নতাই সড়কে নেমে আসে জোর কদমে। ব্যস ওইটুকুই। এর বেশি কিছু হয়ই না। সেই পুরাকাল থেকে চলে আসা শোষণ-বঞ্চনার করুণ আখ্যান আজও তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। বয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর নারী শ্রমিকরা তো তেমন বঞ্চনার কোনো প্রান্তসীমায় পৌঁছায় নিজেরাও জানে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনই নির্মাণ শ্রমিক। মাথায় বালি আর ইটের ভারি বোঝা নিয়ে কর্মস্থলে এক জায়গা থেকে অন্য খানে যাতায়াত করতে হয়। দুজনকেই সমানভাবে। অপেক্ষাকৃত কোমল বলে কিছুমাত্র দায়-দায়িত্ব কিন্তু কম থাকেই না। কিন্তু মজুরির বেলায় কেন এই অহেতুক, অযাচিত বৈষম্য? স্ত্রী নারী শ্রমিক কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। সংসারে সন্তান কিংবা বৃদ্ধ শ্বশুর, শাশুড়ি থাকলে তাদের সেবা-যত্ন, দেখভাল করে কর্মস্থলে ছুটতে হয় তাকে। আরও কত দায়-দায়িত্ব? স্বামী-স্ত্রী যদি এক জায়গায় কাজ করে কিংবা ভিন্ন এলাকায়ও যদি হয়। সেখানে দুজনের শুধু সকালের নাশতা নয়, দুপুরের টিফিন ভাত কিংবা রুটি-তরকারি তৈরি করে বোঝা নিয়ে কাজের জায়গায় যোগ দিতে হয়। আর স্বামী শ্রমিকের কাজ সত্যিই আর এক বিস্ময়। স্বামী ফুলবাবু আসে ধীরে সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। হেলে-দুলে প্রাতঃরাশ সারেন। তারপর পরম নিশ্চিন্তে কর্মস্থলে যোগ দেন। আর স্ত্রীর যাপিত জীবন তো শুরু সেই কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি। সেটা না হয় আবহমান বাঙালি বধূ তার সমাজ-সংস্কারের নিয়মানুগ হয়ে করেই থাকেন। এ জন্য বধূটিও কোনো ওজর আপত্তি কিংবা অভিযোগও করেন না। তবে সেটা কোনো নিয়মবিধির আওতায় পড়েও না। যদি স্ত্রীটি স্বামীর মতো একই কর্মযোগে জড়িত থাকেন। সবচেয়ে আশ্চর্য নারী শ্রমিকদের মুখ বুঝে সহ্য করাই নয় নিরীহ-নির্লিপ্তভাবে তার কঠিন শ্রমের পেশাকে দুর্দান্তভাবে চালিত করাও। কৃষি খেতে যেমন একইভাবে শিল্প-কারখানায়ও নারী শ্রমিকের ক্রমাগত শোষণ-বঞ্চনায় সংশ্লিষ্টরা আন্দোলন আর অসহিষ্ণুতায় উত্তাল হয়ে ওঠেন। কর্র্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করলেও যে লাউ সেই কদু হতে তেমন সময় লাগে না। তা ছাড়া লিঙ্গ বৈষম্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত, প্রতিষ্ঠিত হলেও মজুরি ফারাক কোনো বৈধতা কিংবা অনুমোদন না পাওয়াও উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে যথেষ্ট। তাই শুধু নির্দিষ্ট দিনে দিবস পালন নয় অনাহূত, অযৌক্তিক বিভাজনের প্রাসঙ্গিক যুক্তিমালা ও আইনি কর্মযোগ জরুরি যা সংশ্লিষ্টদের ন্যায্যতা বিবেচনায় সমাজ সংস্কার আর আইনি বিধিতে প্রতিষ্ঠা পাবে। বৈষম্যপীড়িত ছাত্র আন্দোলনে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় পুরানো বহু বিধি অপসংস্কারও বিচলিত হওয়ার মতো। নতুন বাংলাদেশ যেন নব আঙ্গিকে জরাজীর্ণ সব তারতম্যকে মুছে দিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেÑ এটা দেশবাসীর পরম প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা।
অপরাজিতা প্রতিবেদক