ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

রাজশাহীতে ভ্রাম্যমাণ সংগীতানুষ্ঠান

তারুণ্যের উৎসবে বিকশিত সংস্কৃতি, জোরালো হচ্ছে সম্প্রীতি

মামুন-অর-রশিদ

প্রকাশিত: ০০:১১, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

তারুণ্যের উৎসবে বিকশিত সংস্কৃতি, জোরালো হচ্ছে সম্প্রীতি

.

তারুণ্যের উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাজশাহীর বরেন্দ্রসহ দেশের সংস্কৃতিতে প্রাণ ফিরে এসেছে। এখন হারিয়ে যাওয়া নানান সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে তারুণ্যের উৎসব থেকে। রাজশাহী অঞ্চলেও জেগেছে সংস্কৃতি। 
‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানে রাজশাহীতে ধারাবাহিক তারুণ্যের উৎসবে লোকজ সংস্কৃতি যেমন ফিরে এসেছে, তেমনভাবে নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতিও। তারুণ্যের উৎসব উদ্যাপনে মানুষ প্রাণখুলে নানান উৎসবে শামিল হচ্ছেন। নতুন করে সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে নানা ভাষাভাষি মানুষের মধ্যে। জোরালো হচ্ছে সম্প্রীতিও।
জানুয়ারির শুরু থেকেই রাজশাহীর সর্বত্র পর্যায়ক্রমে এসব নানা ধরনের উৎসব পালন করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে তারুণ্যের উৎসব উদ্যাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে হারিয়ে যাওয়া নৃত্য, সংগীত, পালাগান- যেমন, আলকাপ, মাদারগান কোথাও কোথাও যাত্রাপালাও পরিবেশিত হচ্ছে।
সর্বশেষ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুরের আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো দুই দিনব্যাপী সমতল ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সম্প্রীতি সমারোহ। দুইদিনের এ অনুষ্ঠানে রাজোয়াড় জাতিগোষ্ঠীর আল্পনাচিত্র প্রদর্শন ও ১৩ জনগোষ্ঠীর নৃত্য-গীত ও নাট্যানুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। বর্ণিল এ অনুষ্ঠানের শুরু হয় শনিবার বিকেলে। রবিবার রাতে নানা অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে এ উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠানের শুরুতে নেচে গেয়ে অতিথিদের মঞ্চে তোলা হয়। এ অঞ্চলের রীতি অনুযায়ী অতিথিদের পা ধুয়ে দেওয়া হয় নৃত্যের তালে তালে। এ সময় মাদল আর করতালের আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম। হাজারো দর্শক এতে অংশগ্রহণ করেন। 
দুইদিনের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন, পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের চাকমা মারমা, পাংখোয়া, ত্রিপুরা এবং রাজশাহী অঞ্চলের সমতলের সাঁওতাল, ওরাঁও, পাহাড়িয়া, রাজোয়াড়, মুন্ডা, মাহাতো, ভূমিজ, গড়াৎ মাহালী শিল্পীরা। অন্যরকম এ আয়োজনে ফুটে ওঠে হাজার বছরের প্রাচীন নৃত্য ও গীত।
দুইদিনের এ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি বলেন, এদেশে বসবাসরত পাহাড়ি ও সমতল জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, বরেন্দ্রভূমি ও পু-্রভূমিতে রাজোয়াড়, ওরাঁও, সাঁওতাল, বাঙালি নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সবার সংস্কৃতি ধরে রেখে একসঙ্গে বসবাস করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। সংস্কৃতি কেবল আমরা কীভাবে হাঁটি, খাই, বসবাস করি, চলন-ফিরন, আত্মীয়তা, বিয়ে-বন্ধন নয়, সংস্কৃতি হলো আমার নাচ, গান এবং ছবি আঁকাও। এর ভেতর থেকে আমি জীবনকে কেমন করে দেখি, জীবন কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা পরিষ্কার হয়। 
ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ভাষা মানুষকে তার জীবনের উপলব্ধি প্রকাশ করতে সাহায্য করে। একটা ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে একরকম উপলব্ধি হারিয়ে যাওয়া। রাজোয়াড় ভাষা ধরে রাখতে কর্মশালার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ভাষা যাতে অন্যের দ্বারা আত্তীকৃত না হয়ে যায় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, হাতের পাঁচটি আঙুল সমান না, ভিন্নতাই আত্মপরিচয়ের সৃষ্টি করে। আপনি ভিন্ন বলেই বাঙালি আলাদা। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই এই ১৩ জাতিগোষ্ঠী একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করবেন, বাঙালি যারা আছেন তারাও শ্রদ্ধা করতে শিখবেন। কারণ শ্রদ্ধা না করলে অন্য কোথাও গিয়ে আপনি অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে যাবেন। 
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ বলেন, এখন বলা হয় অনেককিছু হারিয়ে যাচ্ছে। আমি বলব এটা হারিয়ে যাওয়া নয় এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের মিশে যাওয়া। তবে মিশে গেলেও নিজস্ব কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। 
বাপ দাদার এলাকা ছেড়ে কোথাও মাইগ্রেট করার চিন্তাও করবেন না-এমন আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আগেও যেভাবে মিলেমিশে ছিলাম এখনো সেভাবে থাকব। দুই-একজন দুর্বৃত্ত যেটা আগেও ছিল হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। যেভাবে শান্তির সঙ্গে সমৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস করতে চান সেটা করবেন। আমরা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চাই।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, একা একা ভালো থাকা যায় না। সবাই মিলে ভালো থাকতে হয়। এই ভালো থাকাটা ধরে রাখতে হবে। 
এদিকে তারুণ্যের উৎসব উদ্যাপন উপলক্ষে রাজশাহী নগরীতে দিনব্যাপী ভ্রাম্যমাণ সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার জেলা তথ্য অফিস আয়োজিত এ সংগীতানুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে প্রধান অতিথি হিসেবে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার।
উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আফিয়া আখতার বলেন, আজকে যে নতুন স্বাধীনতা আমরা উপভোগ করছি সেই স্বাধীনতার কারিগর হচ্ছে তরুণরা। আমাদের সকলের দায়িত্ব, তরুণরা যে আমাদের ভবিষ্যৎ সেটা তাদেরকে ভালোভাবে উপলব্ধি করানো। 
তিনি বলেন, তরুণরা যে কাজ করছে সেই কাজগুলোকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। দেশকে স্ন্দুরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুণদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশে আমরা একযোগে তারুণ্যের উৎসব উদ্যাপন করছি এবং দেশ বদলানোর কারিগরদের উৎসাহ দিচ্ছি। 
অনুষ্ঠানে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহা. যোবায়ের হোসেন, উম্মে কুলসুম সম্পা, টুকটুক তালুকদার, মো. মহিনুল হাসান, জেলা তথ্য অফিসের উপপরিচালক নাফেয়ালা নাসরিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

×