ডাইনোসরের দাঁত, ওরিওডন্টের চোয়াল, প্রস্তুরিভূত কাঠ, দিয়ে সাজানো জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি
কোটি কোটি বছর আগের প্রাণী ও উদ্ভিদের অবশেষ। হ্যাঁ, কোটি কোটি বছর আগের! বারবার দেখেও তাই বিস্ময় কাটে না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের গাছ কালের ব্যবধানে পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাণীর দাঁত, হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন উপাদানও এখন প্রস্তরখ-। এমনকি গাছের পাতা পোকামাকড় মাছ এবং প্রবালের অবয়ব কার্বন কপির মতো দৃশ্যমান।
দেশী বিদেশী এসব ফসিলের দুর্লভ সংগ্রহ এখন জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে। এখানে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ। বিভাগের নিজস্ব গ্যালারিতে যেসব ফসিল প্রতিদিন প্রদর্শিত হয় তার বাইরে আরও অনেক নিদর্শন আছে, যেগুলো অদেখা থেকে যায়। প্রদর্শনী সেগুলো দেখার বিরল সুযোগ করে দিয়েছে। মোট ফসিল বা জীবাশ্ম নিদর্শন সংখ্যা ৬৯টি।
মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, সংরক্ষিত নমুনা কমপক্ষে দশ সহ¯্রাধিক বছরের প্রাচীন হতে হবে। তবেই সেটি ফসিল। ঊনবিংশ শতকে শীর্ষস্থানীয় ভূতাত্ত্বিকগণ ভৌগোলিক সময়ের মানদ-ে ৩৪০ কোটি থেকে ১০ হাজার বছর বয়সের মধ্যে সংগৃহীত বস্তুকে জীবাশ্ম হিসেবে ধরেছিলেন।
জাদুঘর আয়োজিত প্রদর্শনীটি তাই অন্যরকম গুরুত্ব বহন করে। প্রদর্শনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে প্রস্তুরীভূত কাঠ। মানে, গাছ বা কাঠ থেকে পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে। আয়োজকদের দেয়া তথ্য মতে, দেশীয় এসব নিদর্শনের বেশিরভাগই লালমাই হিলস, মানে, কুমিল্লা এলাকা থেকে সংগ্রহ করা।
ফসিল পাথর নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তা নাজমুল হায়দারের দেওয়া তথ্য মতে, লক্ষ বছরের ব্যবধানে কাঠের মূল উপাদান কার্বণ (সি) বিভিন্ন ধরনের খনিজ উপাদানের সঙ্গে ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রস্তরিভূত কাঠে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রস্তরিভূত এসব কাঠের বয়স প্রায় ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ দশমিক ০ মিলিয়ন বছর।
প্রাণীদের মধ্যে ডাইনোসরের কথা আলাদা করে বলতে হয়। জাদুঘরের সংগৃহীত সমস্ত ফসিলের মধ্যে ডাইনোসর সবচেয়ে প্রাচীন বলে জানা যায়। প্রায় সাত কোটি বছর আগের ডাইনোসরের ফসিল আছে জাতীয় জাদুঘরে! প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে মরক্কো থেকে সংগ্রহ করা ডাইনোসরের দাঁত চোয়াল চামড়া পায়ের ছাপ ডিমের অবশেষ। যত দূর তথ্য, পৃথিবীতে ডাইনোসরের দেখা মিলেছিল ২৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। বিলীন হয়েছে, তা-ও, ৬৫ মিলিয়ন বছর হয়ে গেছে! সেই প্রাণীর জীবাশ্ম দেখে অবাক না হয়ে পারা যায়?
যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা ওরিওডন্টের চোয়াল দেখেও চমকিত হতে হয়। জাদুঘরের তথ্য, এটি সমান পায়ের খুর বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী। অনেক আগে বিলীন হয়ে গেছে। জীবাশ্মটি প্রায় চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি বছর আগের। আধুনিক আফ্রিকান হাতির মতো একটি প্রাণী ছিল, নাম উলি ম্যামথ। এই প্রাণীর পায়ের লম্বা হাড় এখন জঙ্গ ধরা লোহার মতো দেখাচ্ছে।
মাছের মধ্যে নাইটিয়া এবং চিংড়ির জীবাশ্ম আছে প্রদর্শনীতে। লেবানন থেকে সংগ্রহ করা চিংড়ির জীবাশ্ম বিস্ময়করভাবে চুনাপাথরের গায়ে লেপ্টে আছে। আকার আকৃতি বোঝতে একদমই অসুবিধে হয় না। একইভাবে পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা ক্ষুদ্র মাছ নাইটিয়ার খোঁজ। কু-লীকৃত সর্পিল খোলসের মতো দেখতে অ্যামোনাইট আয়রন স্টোনের জীবাশ্মও এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
গাছের পাতা বা ফার্ণের জীবাশ্মও লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। অ্যামুনাইট ব্যাকুলাইট নুমুলাইট ট্রাইলোবাইট ব্রাকিওপড, কাস্ট ইত্যাদি নিজ নিজ সময়ের কথা প্রকৃতি পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এসবের বাইরে প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে ৬৬টি প্রবাল জীবাশ্ম।
প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের কর্মকর্তা ড. সুমনা আফরোজ বলেন, ভূত্বকের শীলাস্তরের ওপর উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহাবশেষ সংরক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি বছর আগের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাই আমরা। আমাদের গ্রহের ভৌগোলিক ইতিহাস, জৈবিক ইতিহাস, গ্রহে বসবাসকারী জীব, জীবনযাত্রা, তাদের বিবর্তন, সে সময়ের প্রকৃতি পরিবেশ এবং পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন ছিল তা জানতে পারি। জানতে এবং জানানোর আগ্রহ থেকেই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
অবশ্য ইতোমধ্যে জীবাশ্ম প্রদর্শনী শেষ হতে চলেছে। গত ১৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রদর্শনী আগামী ২৮ জানুয়ারি শেষ হবে।