ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

মায়াকাড়া মহামায়া লেক

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

মায়াকাড়া মহামায়া লেক

মীরসরাইয়ের মহামায়া লেক, ইনসেটে পর্যটকদের ভিড়

চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম জলাধার মহামায়া লেক। সবুজে ঘেরা ছোট-বড় পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা স্বচ্ছ  নীলাভ জলের এই লেক আর পাহাড়ি ঝরনা প্রকৃতির অপূর্ব নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন এখানে।
সরেজমিনে মহামায়া লেকটি ঘুরে দেখা যায়, ২০১০ সালে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হওয়া মহামায়া লেকের আয়তন ১১ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়, ঝরনা ও নীলাভ জলের অপূর্ব মেলবন্ধন এটিকে বিশেষ আকর্ষণীয় করেছে। শীতের সময় অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ মহামায়াকে করে তোলে আরও মনোমুগ্ধকর।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই উপজেলার ঠাকুর দীঘি বাজারের এক কিলোমিটার পূর্বে। ছায়াঘেরা সড়ক। রাস্তায় প্রস্তুত আছে অটোরিক্সা। কিছুদূর পর দেখা মিলবে রেলপথ। রেললাইন পেরুলেই কাছে টানবে মহামায়া। প্রাণের টানে ছুটে আসা পথ যেন ক্রমশই বন্ধুর হতে চাইবে মনের কোণে জায়গা মৃদু উত্তেজনায়। দূর থেকে দেখা যায় প্রায় পাহাড়সম বাঁধ। উভয় পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাঁধে উঠতেই! আহ, কি অপরূপ শোভা। বাঁধের ধারে অপেক্ষমাণ সারি সারি ডিঙি নৌকা আর ইঞ্জিনচালিত বোট। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে তাকাতেই দেখা যায় নীলাকাশ। পূর্ব-দিগন্তের সারি পাহাড়ের বুক চিরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যেতেও মন চাইবে কল্পনায়। সঙ্গের সাথী পাশে নিয়ে গেলে তো কথাই নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে গেলেও কোনো মানা নেই। কিছুদূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের কান্না। অঝোরে কাঁদছে। অথচ তার কান্না দেখে নিজের কাঁদতে ইচ্ছে হবে না। উপরন্তু কান্নার জলে গা ভাসাতে মন চাইবে। তারও পূর্বে যেখানে লেকের শেষপ্রান্ত, সেখানেও বইছে ঝর্ণাধারা। মাঝপথে থেমে গিয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে নিজেকে গর্ববোধ করতেও পারেন। কেননা, সেখান থেকে দেখা মিলবে দূরের পথ। এক কিলোমিটার দূরের মহাসড়ক, তার অর্ধেকের রেলপথ, ট্রেনের ছুটে চলা, কৃষাণির ধান মাড়ানো, কৃষকের ফলন, কিশোরের দুরন্তপনা; এসবই দেখা মিলবে চূড়া থেকে।
লেকের নীল জলরাশিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নৌকা ভ্রমণের সুবিধা। ডিঙি নৌকা, ময়ূর পঙ্খী নৌকা ছাড়াও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য কায়াকিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। লাইফ জ্যাকেট পরে বৈঠা বেয়ে পর্যটকরা উপভোগ করছেন প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
ঘুরতে আসা পর্যটক শিক্ষার্থী শারমিন ও প্রিয়া বলেন, ‘প্রকৃতির কোলে প্রশান্তির জন্য মহামায়া লেক প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। মহামায়া লেকের এই সৌন্দর্য যেন প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। বিশেষ করে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে লেকের নীলাভ জলে কায়াকিং করা ও পাহাড়ি ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করা দারুণ অনুভূতি।
মহামায়া ইকো পার্কের ব্যবস্থাপক আবু হানিফ বলেন, লেকের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে মহামায়া ইকো পার্ক। এখানে পিকনিকের জন্য উন্মুক্ত মাঠ, ক্যান্টিন, ইবাদতখানা, ডেকোরেটর সার্ভিস এবং উন্নত শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে। এটি পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভ্রমণ ও পিকনিকের জন্য একটি আদর্শ স্থান বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের মীরসরাই রেঞ্জ অফিসার শাহানশাহ্ নওশাদ জানান, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতসহ মহামায়া লেককে একটি মানসম্পন্ন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।’
রাজিব মজুমদার, মীরসরাই, চট্টগ্রাম

গঙ্গামতি সৈকত ॥ চোখ ফেরানো যায় না

যেন চোখ ফেরানো যায় না। আঁকাবাঁকা সৈকতের বেলাভূমে আছড়ে পড়ছে লোনা জলের ঢেউ। কোনো শেষ নেই। একটির ওপর আরেকটি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অবিরত ঢেউয়ের শো শো শব্দে মনপ্রাণ জুড়িয়ে হিমশীতল হয়ে পড়ছে। মনে পড়ে যায় হারানো দিনের অনেক স্মৃতিময় মুহূর্ত। এই তো সাগরের চেনা চেহারা। মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। শান্ত করে দেয়। আর যদি হয় মানুষটি প্রকৃতি প্রেমিক; তো কথাই নেই। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটির কোল ঘেঁষে রয়েছে ঝাউবিথি। সারি সারি গাছগুলো যেন একে অপরকে টেক্কা দিয়ে উপরে ওঠার অবিরাম চেষ্টায় রত আছে। এর ছাঁয়াতলে হাটাচলা, আবার সৈকতের লোনা জলে পা ভেজানো। কেউবা অতি আপনজন, অর্ধাঙ্গীনী কিংবা বন্ধুকে নিয়ে হাত ধরে হেঁটে চলা। সৈকতের জলের আধোভেজা শিহরণ। শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি। যেন শরীরকে গলানো মোমের মতো করে দেয়। উষ্ণ এ ভাব উপলব্ধি থেকেই অনুমেয়। চোখে না দেখলে বর্ণনায় শেষ হয় না। এমন উপভোগ্য স্থান হচ্ছে গঙ্গামতি সমুদ্র সৈকত।

কলাপাড়ায় গঙ্গামতি সৈকত
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নে দক্ষিণে সাগরের কোলঘেঁষা এক জনপদ। সৈকতের এ স্পটটিও বিরল মনোলোভা দৃশ্য সূর্যোদয় ও অস্ত দেখার জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন প্রত্যুষে আসছেন পর্যটক। সন্ধ্যায়ও ভিড় করছেন। কারও কাছে গঙ্গামতির এ সৈকত লাল কাকড়ার চর নামেও সমধিক পরিচিত। সৈকতের বেলাভূমে লাল কাঁকড়ার ভোঁ দৌড় এক অনন্য উপভোগ্য দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। তবে মানুষের বিচরণের পাশাপাশি কাঁকড়া ধরার মানসিকতার কারণে মারা পড়ছে বহু লাল কাকড়া। অভিজ্ঞজনের মতামত লাল কাঁকড়া দূর থেকে অবলোকন করার জন্য নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। নইলে হারিয়ে যাবে প্রকৃতির এই সাজানো নৈসর্গিক দৃশ্যপট। সাগরের রাবনাবাদ মোহনা যেখান থেকে শুরু। দৃশ্যপট এখন আরও আকর্ষণীয় হয়ে গেছে, সাগরপথের এই বাঁকটি এখন দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রার প্রবেশদ্বার হওয়ায়। দিনভর পর্যটক-দর্শনার্থীর হৈ-হুল্লুরে মাতোয়ারা থাকছে। সৈকতটি রক্ষায় ১৯৯৮ সালে ঘোষণা হয় পর্যটনপল্লী। এরপর থেকে এ চরটির প্রায় ২০০০ একর সরকারি আবাদযোগ্য খাস জমি এখনো ভূমিদস্যুদের কবলমুক্ত রয়েছে। যার কল্যাণে এখানে সরকারের উন্নয়ন কাজে কোন জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে না। সৈকতে যাওয়ার সড়কটি ইতোমধ্যে পাকাকরণ করা হয়েছে। গঙ্গামতির লেকটির ওপরে একটি গার্ডার ব্রিজ করা হয়েছে। ঝাউবিথির পাশ ঘেঁষে অস্থায়ী দোকানপাট বসছে। কুয়াকাটায় আসলে কেউ এই সৈকতটি দেখার সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায় না। করে না কেউ এমন ভুলটি। বিদ্যুতের আলো এখানে পৌঁছেছে বহু আগেই। সৈকতের দীর্ঘ এলাকার বেলাভূমে আবাদ এবং বসতবাড়ি করে আছে হাজার খানেক পরিবারের। মূলত এরা সবাই জেলে। আবার মৌসুমে ধানের সঙ্গে রবিশস্যের আবাদও করেন। এখনো গঙ্গামতির এই সৈকতে পর্যটকের জন্য সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন ছাড়া তেমন কোনো সুবিধা গড়ে ওঠেনি। সম্ভাবনাময় এ সৈকতে একসময় শুধু শীতকালে পর্যটকের পদচারণা থাকতো। এখন বর্ষাকালেও আগমন ঘটে প্রচুর পর্যটক-দর্শনার্থীর।
সৈকতের দীর্ঘ এলাকা ভ্রমণ ছাড়াও প্রকৃতিঘেরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। রয়েছে জেলেদের জীবনযাত্রার যুদ্ধের প্রতিদিনকার দৃশ্যপট দেখার সুযোগ। ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, এখন রাতের বেলাও পর্যটকের যাওয়া-আসায় সমস্যা হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, গঙ্গামতি সৈকতে যাওয়ার সংযোগ সড়কটি এ বছর নির্মাণ করা হচ্ছে। পর্যটকের সুবিধার জন্য কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। কুয়াকাটা থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে কিংবা হোন্ডা-অটোবাইকে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এ সৈকতে। এছাড়া কলাপাড়া উপজেলা সদর থেকে বালিয়াতলী থেকে কুয়াকাটাগামী বিকল্প সড়কে যাওয়া যায় গঙ্গামতি সৈকতে।
মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া

ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি
নবরত্ন মন্দির

আবহমান গ্রাম বাংলার ধারকবাহক অনেক ঐতিহ্য সংরক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে। তেমনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া গ্রামে নির্মিত ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি নবরত্ন মন্দির কালের বিবর্তনে, সময়ের পরিধিতে বিলুপ্তির পথে!
ঐতিহাসিকদের মতে, মন্দিরটি সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরটি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এর ভাঙ্গা স্তূপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বহু কিংবদন্তি ও অলীক কাহিনি। এক সময়ের দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরের এখন শুধু কিছু ইটের টুকরো, বিক্ষিপ্ত দেয়াল ও মেঝের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। কথিত আছে, এই গ্রামের এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী বরেন্দ্র কায়স্থবংশীয় রায় পরিবারের গোবিন্দরাম রায় নামক এক ব্যক্তি ব্যয়বহুল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে এ নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা বিভিন্নভাবে মতপ্রকাশ করেছেন।

 মাদারীপুরের ৩শ’ বছরের লোকমেলা
১৯২৫ সালে প্রকাশিত পাবনা জেলার ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ, ‘মন্দিরটি ইষ্টক ও পরিচূর্ণ দ্বারা নির্মিত ছিল। ইহা ত্রিতল বেদমন্দির ও প্রত্যেক তলে তিনটি প্রকোষ্ঠ বর্তমান ছিল। সর্বসমেত ৯টি প্রকোষ্ঠের কারণে এর নাম নবরত্ন মন্দির হয়েছে। এর গায়ে নানা প্রকার কারুকার্য ও নানারূপ দেবদেবীর মূর্তি খোদিত ছিল। বর্তমানে মন্দিরটি একেবারেই বিনষ্ট হলেও ওই সমুদয় শিল্পকর্মের নিদর্শন অদ্যাপি ইতস্ত বিক্ষিপ্ত ইষ্টকাবলীয় কার্যাদিতে প্রতীয়মান হয়। মন্দিরে রাধাবল্লভ নামক বিগ্রহ স্থাপিত ছিল। এখন পর্যন্ত এখানকার রায়বংশীয়গণের গৃহদেবতা স্বরূপে পূজিত। প্রথম তলে পূজোপকরণ সামগ্রী রক্ষিত হতো। দ্বিতীয় তলে পুরোহিত ও পরিচালকবৃন্দ বাস করতেন। তৃতীয় বা সর্বোচ্চ তলে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইহার তলদেশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিকেই প্রায় ৬০ হাতের ওপর ছিল। ইহার উচ্চতা এতই অধিক ছিল যে, বহু দূরবর্তী প্রদেশ হতে তারা দৃষ্টিগোচর হতো। অধুনা মন্দিরটি বিনষ্ট হলেও ভগ্নাবশিষ্ট অংশের উচ্চতা ২৫ হাতের কম নয়।’
ভবানীনাথ রায় তার রচিত ‘হিন্দু বিজ্ঞান সূত্র’ নামক গ্রন্থে এই মন্দির সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, ‘ইহার উচ্চতা এত অধিক ছিল যে, জনপথে তৎকালীন বঙ্গের রাজধানী ঢাকা হতে যাতায়াতকালে নবাব এই মন্দিরের চূড়া দেখতে পান এবং ঈর্ষাপরবশ হয়ে তা ভাঙার নির্দেশ দেন। মন্দির স্বামী পরিবারস্থ লোকেরা তার পূর্বাভাস বুঝতে পেরে সপরিবারে বিগ্রহসহ কিছুদিনের জন্য স্বগ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হন। মুসলমানগণ পোতাজিয়া আক্রমণ করে। তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করত মন্দিরের মধ্যে হিন্দু ধর্ম বিগর্হিত কার্যাদি সম্পাদন করেন এবং অগ্নি প্রদানে সমস্ত বাটি ভস্মীভূত করেন। তদবধি মন্দিরটি হতশ্রী হতে থাকে। ’
তবে ইতিহাস গবেষক আক্তার উদ্দিন মানিক এসব তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। সিরাজগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘উপরের বক্তব্যগুলো অনুমান মাত্র। এটাকে সত্য হিসেবে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি নবরত্ন মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিনাজপুরের কান্তজী’র মন্দির, সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলের নবরত্ন মন্দির এবং পোতাজিয়ার নবরত্ন মন্দিরগুলো সবই নবাবী আমলে নির্মিত হয়েছিল। নবাবদের হিন্দু বংশীয় দেওয়ান বা জমিদারগণ ওই মন্দিরসমূহ নির্মাণ করেন। পোতাজিয়া নবরত্ন মন্দিরটিও ওই সময়ের, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কথিত পোতাজিয়া নবরত্ন মন্দিরের নির্মাতা গোবিন্দরাম রায় ঢাকার নবাবদের দেওয়ান রূপে কর্মরত ছিলেন। এরূপ কথাও উল্লিখিত রয়েছে। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ যাতায়াত নৌকাপথে করতে গেলে পোতাজিয়া গ্রামটি কোনোভাবেই চোখে পড়ার কথা নয়। কারণ পোতাজিয়া গ্রামটি প্রত্যন্ত গ্রাম জনপদ। কোনোভাবেই এটা পদ্মা বা যমুনা নদীর যাত্রাপথে চোখে পড়ার কথা নয়। আরও দুই একজন লেখক এই নবরত্ন মন্দির সম্পর্কে নানা মন্তব্য করলেও এর ধ্বংসের প্রকৃত কোনো কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্প বা কোনো দস্যুদলের আক্রমণেও এই নির্মাণটি ধ্বংস হতে পারে বলে এরূপ অনুমান করাই যথাযথ বলে মনে হয়।’

সৈয়দ হুমায়ুন পারভেজ শাব্বির,
শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
তিনশত বছরের
লোকমেলা

মাদারীপুরে পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে শুরু হয়েছে ৩শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী লোকমেলা (পৌষমেলা) ও কবিগান। রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রমসংঘ ও খালিয়ার সেনদিয়ায় সপ্তাহব্যাপী কবিগান ও পক্ষকালব্যাপী লোকমেলা। লোকমেলা ও কবিগান শুনতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। গভীররাত পর্যন্ত চলছে গান ও মেলা। মেলায় কোনো ধরনের চাঁদাবাজি ও বখাটেদের উপদ্রপ না থাকায় দর্শনার্থী, ক্রেতা ও বিক্রেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। কবিগান ও ঐতিহ্যবাহী পৌষ মেলা যুগ-যুগ টিকিয়ে রাখতে আয়োজকরা বদ্ধপরিকর।
আয়োজকরা জানান, শত বছর পূর্বে মহামানব গনেশ পাগল পৌষমাসের শেষ মঙ্গলবার কালী পূজার মধ্য দিয়ে কবিগানের আয়োজন করেছিলেন এবং নিজে আশ্রমের ঈশান কোণের আসরে বসে কবিগান শ্রবণ করতেন। সেই থেকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী মহামানব শ্রীশ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রমসংঘে প্রতিবছর ১৫ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী লোকমেলা (পৌষমেলা) পাশাপাশি কবিগানের আয়োজন করা হয়। এই পৌষমেলা বসে ১৫ দিনব্যাপী। কদমবাড়ীর ৭ দিনব্যাপী কবিগানের আয়োজন করা হয়। এ বছরও বাংলাদেশ চারণ কবিসংঘের সভাপতি কবি স্বপন সরকার, কবি তিমির সরকার, কবি সম্রাট সরকার, কবি অপূর্বলাল সরকার, কবি সুরেশ সরকার, কবি সঞ্জয় সরকারসহ বেশ কয়েকজন কবিয়াল অংশগ্রহণ করেছেন। মেলায় সহস্রাধিক বিভিন্ন ধরনের স্টল বসেছে। মেলায় বিভিন্ন দেশী পণ্যের বিক্রিও ভালো হচ্ছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। অনেক রাতেও ক্রেতা সাধারণ ও দর্শনার্থীরা নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে পারছেন।
মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রমে কবিগানে অংশ গ্রহণ করা প্রখ্যাত কবিয়াল স্বপন সরকার ও তিমির সরকারের কাছে কবিগান নিয়ে কথা হলে তারা জানান, ‘কবিগান মানুষের মধ্যে আত্মচেতনা প্রস্ফুটিত করে, কবিগানের ভিতরে প্রেম-পবিত্রতা ফুটে ওঠে, আধ্যাত্মিক চেতনা ফুটে ওঠে, বিশ^ মানবতা ফুটে ওঠে, মানুষের মধ্যে থেকে হিংসা, নিন্দা দূরীভূত হয়, মানুষের মধ্যে এমন প্রেম জাগরিত হয় যে, কবিগানের ভিতরে একজন আরেকজনকে ধরে ভাব ভক্তিতে আলিঙ্গন করে। কবিগানের মধ্য দিয়ে মানুষকে সৎ পথে আনার দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করে।’ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ^ মানবতার জন্য কবিগান গেয়ে যাওয়ার কথা বললেন প্রখ্যাত দুই কবি।
এ দিকে একই উপজেলার খালিয়ার সেনদিয়ায় শ্রীশ্রী কৃষ্ণ-কালীপূজা ও পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে শুরু হয়েছে ৫ দিনব্যাপী কবিগান ও পক্ষকালব্যাপী পৌষ মেলা। ৩ শতাধিক বছর ধরে সেনদিয়ার কৃষ্ণ-কালীমন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ৫দিনব্যাপী কবিগানের আসর। এ বছর কবিগানে অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশে চারণ কবিসংঘের সদস্য প্রখ্যাত কবিয়াল সুরেশ সরকার, কবি সঞ্জয় সরকার ও সহ শিল্পীবৃন্দ। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত কবিগান শ্রবণ করতে আসেন। এ উপলক্ষে ১৫ দিনব্যাপী বসেছে পৌষমেলা। এ মেলাও ৫ শতাধিক বিভিন্ন ধরনের স্টল বসেছে। অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মেলা কমিটি। দুই মেলায় কবিগান শুনতে আসা শ্রোতারা কবিগানকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ জানালেন এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীরা জানালেন তাদের অনুভূতি।

শাহজাদপুরের নবরত্ন মন্দির
কদমবাড়ী মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘে কবিগান শুনতে আসা চিনে গবেষণারত গোপালগঞ্জের ড. শুভ মণ্ডল ও তার সহধর্মিণী সেতু বিশ^াস জানান, ‘মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘের ঐতিহ্যবাহী কবিগান ও পৌষমেলায় আসার জন্য একটি বছর অপেক্ষায় ছিলাম। তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেলা ঘুরে দেখছেন এবং কেনাকাটা করেছেন। মেলা এবং কবিগান তাদের খুব ভালো লেগেছে। গোপালগঞ্জের অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র দাস জানান, ‘কবিগান শ্রবণ করা মানে আধ্যাত্মিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাই মানুষকে সৎপথে আনার জন্য মাঝে মধ্যে কবিগান শ্রবণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। কদমবাড়ী গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘের অধ্যক্ষ অতুল গোস্বামী জানান, মহামানব গণেশ পাগল নিজেই এক শত বছর পূর্বে শ্রীশ্রী কালীমাতার পূজা করেছিলেন এবং কবিগানের আয়োজন করে গেছেন। তিনি নিজে আসরের ঈশান কোণে বসে কবি গান শ্রবণ করতেন। সেই থেকে কবিগান ও পৌষ মেলা চলে আসছে। পাগলের নিজের দেওয়া কবিগান ও মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
কদমবাড়ী মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘ ও পৌষ মেলা (লোকমেলা) কমিটির সভাপতি মিরন বিশ^াস জানান, লোকসাহিত্যে চারণ কবিদের কবিগান ঐতিহ্য। বাংলাদেশের খ্যাতনামা কবি সম্রাট রাজেন সরকার, কবি বিজয় সরকার, কবি রশিক সরকার, কবি অসিম সরকার, কবি নকুল সরকার, কবি অনাদি সরকার, কবি নিশিকান্ত সরকারসহ অসংখ্য কবিয়াল এ কদমবাড়ীর এই আসরে কবিগান পরিবেশন করছেন। এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য মেলা কমিটির সদস্যবৃন্দ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সেনদিয়া মেলা উদযাপন কমিটি সভাপতি খোকন মণ্ডল জানান, সেনদিয়া পশ্চিমপাড়া মাঠে প্রায় ৩শ’ বছর যাবৎ মেলা ও কবিগান চলে আসছে। বড় বড় নামি-দামি কবিরা এ মাঠে কবিগান পরিবেশন করেছেন এবং করছেন। আমরা সবাই মিলে এখানকার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য বদ্ধপরিকর।
সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর

×