ইচ্ছে শক্তি ও মনোবল দৃঢ় হলে যে কোনো ভালো কাজে সহজেই ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। পাশাপাশি অভাবি সংসারকে আলোয় আলোকিত করা কোনো কঠিন কিছুই না। তেমনি এক গৃহিণী মেরিনা বেগম।
উত্তরাঞ্চলের ভারত সীমান্তবর্তী নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি বন্দরের প্রত্যন্ত এলাকা ভোগডাবুড়ি ইউনিয়নের ছয় ফুটিয়া গ্রাম। এ গ্রামের কৃষকবধূ মেরিনা বেগম হাঁস চাষে বা পালনে নিঃশব্দ বিপ্লব নিয়ে এসেছে। বিদেশী জাতের পেকিন হাঁস পালনে স্বাবলম্বী হয়েছেন। দারিদ্র্যতাকে জয় করে নিজেকে সফল খামারি হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। তার সফলতা দেখে অনেকে নারীরাই পেকিন হাঁস পালনে এগিয়ে আসছেন। কেউ আগে কল্পনাও করেনি হাঁস, মুরগির চেয়ে বেশি ডিম দেয় বা দিতে পারে। হাঁস থেকে রীতিমতো ব্যবসা করা যায়। গ্রামের মানুষেরা এখন সুযোগ পেয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে হাঁস পালনে খামার গড়ে তোলার। ফলে ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়, আমাদের গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটছে। ঘরে ঘরে এখন অভাবও নেই।
সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর অর্থায়নে এবং কারিগরি সহযোগিতায় এই হাঁস পালনের কারণেই মেরিনার দুঃখের সংসারে এখন সুখের সুবাতাস বইছে।
নারী উদ্যোক্তা গ্রামীণ বধূ এই খামারি মেরিনা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সংসারে খুব অভাব ছিল। দুই ছেলে রাকিব ও রহিম। স্বামী ইব্রাহিম আলী। দিন মজুরি ও অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হতো। মেরিনা জানালেন, ২০২১ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে মাত্র ৫টি পেকিন হাঁস পালন শুরু করি। ঋণ নেই দশ হাজার টাকা। স্বামী ও সন্তানরা আমাকে এই হাঁস লালন-পালনে সব সময় সহায়তা করেন।
জানা গেল দুই বছর আগের সেই ৫টি হাঁস থেকে বর্তমানে মেরিনার খামারে ১০০টি সাদা ধবধবে পিকিন হাঁস রয়েছে। বাজারে যেতে হয় না। চাহিদা বেশি থাকায় ক্রেতারা বাড়িতে এসেই হাঁসের ডিম ৬০ টাকা হালি ধরে কিনে নিয়ে যায়। এ ছাড়া এক একটি হাঁস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। বর্তমানে এই হাঁসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিটি হাঁস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। প্রতিটি হাঁস বছরে ডিম দেয় ২০০ থেকে ২৫০টি। এই হাঁসের মাংস খেতে বেশ সুস্বাদু, পুষ্টিগুণাগুণ সমৃদ্ধ ও নরম হওয়ায় সব বয়সের লোকজন পেকিন হাঁসের মাংস খেতে পারেন।
মেরিনা বেগম আরও বলেন, অন্য দেশীয় হাঁসের তুলনায় রোগ-বালাই অনেক কম, আবার ২ মাসেই ওজন আসে ৩ কেজি। ফলে পেকিন হাঁস পালন বেশ লাভজনক। তাই আমি ছাড়াও অনেক নারীরা এই হাঁস পালনে আগ্রহী হচ্ছেন।
জানা যায়Ñ মেরিনা বেগমের এই হাঁস পালনে বেসরকারি সংস্থা শার্পের চিলাহাটি শাখা হতে প্রশিক্ষণ নেন। মেরিনার ইচ্ছে ৫টি হাঁস থেকে এখন ১০০টি হাঁস হয়েছে। তেমনি আগামী দিনে তার খামারে ১০০০ পেকিন জাতের হাঁস এর খামার করবেন। হাঁসের বাচ্চার সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য হ্যাচারি গড়ে তুলবেন। দুই বছরে হাঁস পালন, ডিম ও হাঁস বিক্রি করে মেরিনা খরচ বাদে প্রায় ৫ লাখ টাকা পুঁজি করেছেন।
মেরিনার স্বামী ইব্রাহিম আলী জানালেন কষ্টে সংসারে তার স্ত্রী এই হাঁস পালন করে সুখের সংসার গড়ে তুলে আলোয় আলোকিত করে তুলেছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন- শার্পের সমন্বিত কৃষি ইউনিট প্রাণিসম্পদ খাতের মাধ্যমে পেকিন জাতের হাঁস সম্প্রসারণ হচ্ছে। পানিতে না ছেড়েও এ হাঁস পালন করা যায়। এ হাঁস দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় বেশি আয় করা যায়।
পেকিন হাঁস বেশ বুদ্ধিমান ও সতর্ক পাখি। এদের কাছাকাছি যে কোনো শিকারি সম্পর্কে অন্যকে সতর্ক করার জন্য তারা উচ্চৈঃস্বরে কাঁপবে। অন্যান্য মাংসের হাঁসের জাতের তুলনায় এরা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পেকিন হাঁস বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। এরা পোষাপ্রাণী হিসেবে খুব ভালো। সাধারণত এরা বেশ দীর্ঘ আয়ু পায়। এদের গড় আয়ু প্রায় ৯-১২ বছর। কিছু হাঁস আর বেশি দিন বাঁচে।
মেরিনা দম্পতির স্বপ্ন, তারা ১০০০ পেকিন জাতের হাঁস এর খামার করবেন। বাচ্চার সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য হ্যাচারি গড়ে তুলবেন। আমরা তাদের এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও জানান, পুরুষের পাশাপাশি এখন নারীরাও উদ্যোক্তা হচ্ছেন। নানা উদ্যোগ নিয়ে গ্রামীণ নারীরাও এখন দরিদ্রতাকে দূর করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
মেরিনার খামারে আদর্শ পোষাপ্রাণী পেকিন হাঁস
শীর্ষ সংবাদ: