ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

নারী স্বাস্থ্য ॥ চাই পুষ্টিকর খাবার

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

নারী স্বাস্থ্য ॥ চাই পুষ্টিকর খাবার

সমসংখ্যক নারীর নানামাত্রিক বিপন্ন সমাজ-সংস্কারে প্রচলিত এক অব্যবস্থাপনা। সেখানে কন্যা শিশু থেকে কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক নারীরাও রুদ্ধতার আবর্তে স্বাস্থ্যহানির বিপাকে। যেখানে সমসংখ্যক নারীর পুষ্টিগত খাবার এক আবশ্যকীয় বিস্ময়। কারণ বৈষম্যপীড়িত যে কোনো সমাজে শারীরিকভাবে কোমল ও অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অংশ বিভিন্ন কারণে-অকারণে তারতম্যের শিকারে পড়া যেন চিরকালের এক দুর্ভেদ্য জাল বিস্তার। সেই সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই। যখন অবধি বিত্ত-নির্বিত্তের ফারাক দৃশ্যমান হয়নি সেই আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষের বৈষম্য যেন সৃষ্টি দ্যোতনার অন্যতম কঠিন বিভাজন। এখন আমরা অতিক্রম করছি একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্য গগনে। তেমন দীর্ঘকালীন অপঘাত থেকে আজও সমসংখ্যকের মুক্তি না মেলাও সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের প্রাচীরসম দুর্বিপাক। যাকে আধুনিক শিল্প প্রযুক্তির নবদ্যুতির আবহেও ঠেকানো গেল না। প্রশ্ন উঠেছে বারে বারে। কিন্তু কোনো সদুত্তর না মেলা ও অপসংস্কারের কবল থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভবের পর্যায়। যা শুধু বিবেচনার বাইরে নয় বরং চলমান গতি প্রবাহেরও উল্টো রথ। যেখানে সামাজিক বৈষম্যই মাথাচাড়া দেয় তার সূতিকাগার যে ক্ষুদ্র পারিবারিক আঙিনা বলার অপেক্ষায় থাকেই না। পরিবার বিশ^ সৃষ্টির অতি আদিম কালের প্রথম সামাজিক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। সেই পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কারণ অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিবাহে পিতৃত্বের পরিচয় ছিল অজানা বিস্ময়। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে মাকেই চেনা যেত। সেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার কিভাবে একক পরিবারে রূপ নিল তাও ঐতিহাসিক পরিবর্তন, পরিবর্ধনের এগিয়ে চলার ভিন্ন মাত্রার ধাপ ক্রমান্বয়ে একক পরিবারে ভিত্তি নাকি নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। বস্তুবাদী সমাজ বিজ্ঞানী এঙ্গেলস এর যথার্থ উক্তি। কারণ একক পরিবারে পিতার পরিচয় যখন নিশ্চিত আর স্বীকৃত হলো তখন থেকেই সমসংখ্যক নারীর অনেকটাই পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ার চরম দুঃসময় শুরু হলো। পরিবারের মূল শক্তিই যখন পিতৃতান্ত্রিক তাই জন্মদাতা চিহ্নিত পিতা ও মায়ের ঊর্ধ্বে স্থান পাওয়া যেন সমাজ সংস্কারের নিয়ম বিধিতে পরিণত হলো। তবে ক্ষুদ্র আদিম নৃগোষ্ঠী এখনো বাংলাদেশেও অনেক জায়গায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছে। যেমন ময়মনসিংহের গারো উপজাতি আজও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। আবার চা শিল্পনগরী সিলেটের খাসিয়া পুঞ্জি ও মাতৃপ্রধান পরিবারে আধুনিক সভ্যতার আলোকে নিজেদের গোষ্ঠীগত ভাব ধারণাকে অক্ষুণ্ন্ন রেখেছে। কিন্তু আধুনিকতার পরম নির্মাল্যে বিশ^ব্যাপী যখন পিতৃতান্ত্রিকতার আদলে পারিবারিক গঠন প্রণালী সেখানে মায়ের অবদান কতখানি স্বীকৃত কিংবা অবহেলিত তাও প্রশ্ন উঠছে বারে বারে বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হচ্ছে শুধু কন্যাশিশু বিয়ে নয় বরং পুষ্টিহীনতায় অপরিণত বিবাহ আরও ঝুঁকিপূর্ণ। দশ মাস দশ দিন জঠরে ধারণ করা মা যখন পুষ্টিসম্মত আহার স্বামী আর পুত্র-সন্তানের জন্য আলাদাভাবে তুলে রাখেন সেটাও সমাজের প্রচলিত সংস্কার। নিজে যেমন পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে একই তার কন্যা শিশুটিও পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ব্র্যাকে’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয় একজন শিশুকন্যা প্রথম তা গর্ভধারিণী মায়ের হাতেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। যে মা সহজেই ভুলতে বসেন তিনিও তার সহোদর ভাইটির সঙ্গে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। গৃহিণী মাও কিন্তু পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার নিজের জন্য রাখেন না।
সামনে এসে দাঁড়ায় স্বামী আর পুত্র। এটা একক পরিবারের দুঃসহ চিত্র। কিন্তু যেথ কিংবা একান্নবর্তী পরিবারে মা আর কন্যা শিশুর অবস্থা আরও দুর্বিষহ। শাশুড়ি মা কিন্তু নিজের জন্য সামান্য পুষ্টি রাখলেও পুত্রবধূর জন্য ছিঁটেফোটাও রাখেন না। শিশু- কিশোরী এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীও স্বাস্থ্যসম্মত আহার থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হওয়ার ইতিবৃত্ত সেই পুরাকালই শুধু নয় আধুনিক শিল্পোন্নত বলয়েও তেমন বিধি এখনো চলছে। যার কারণে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছে উচ্চতায় খাটো হওয়া থেকে শুরু করে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত হওয়া শিশু-কিশোরী আর গর্ভবতী নারীর জন্য চলমান এক দুঃসহ আবর্ত। তবে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা আর গোলটেবিল বৈঠকে সোচ্চার হওয়া যেমন জরুরি সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও সময়ের ন্যায্যতা।
নারীদের পুষ্টিজনিত খাবার তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক জরুরি। প্রতি মাসে ঋতুস্রাবে যে রক্তক্ষরণ তা যদিও প্রাকৃতিক এবং প্রজনন নির্ভর শক্তি তার পরেও তেমন ঘাটতি সম্পূরণও কিশোরী ও সব বয়সের নারীর জন্য নিতান্ত দায়বদ্ধতা। এখানে সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা বিশ^ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়-দায়িত্ব প্রাতিষ্ঠানিক। উপদেশ, পরামর্শ, চিকিৎসা এসব শুরু করতে হবে একেবারে পারিবারিক নির্মল আবহে। যা কি না গৃহিণী মায়ের হাত ধরেই। কন্যা-পুত্র যে সন্তানই হোক না কেন তার যথার্থ সুরক্ষা জন্মদাত্রী মায়েরই সবার আগে। আর এখন একক পরিবারের আদলে যে স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশ সেখানে মাকেও তার পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টি গ্রহণ করতে হবে নির্দ্বিধায়, অবলীলায়। পরিবারের গৃহিণী যদি পুষ্টিহীনতা রুগ্ন স্বাস্থ্যে বিড়ম্বিত হন তা হলে আগামীর প্রজন্ম থেকে পুরো পরিবার বিপন্নতায় দুঃসহকাল অতিক্রম করতে বাধ্য হবে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এমন অমৃত বাণী যুগ-যুগান্তরের। যা কিশোরী ও নারীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও নিতান্ত জরুরি। 

×