বিশ্বের মানচিত্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে—প্রাচীন সাম্রাজ্যের পতন, নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব, কিংবা স্থানীয় নামের পরিবর্তনের মাধ্যমে। সময়ের সাথে অনেক দেশ হারিয়ে গেছে, আবার নতুন কিছু দেশ মানচিত্রে যোগ হয়েছে। আসুন, এমন কিছু হারিয়ে যাওয়া দেশের গল্প জানি, যেগুলো একসময় নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে অস্তিত্ব রেখেছিল।
তিব্বত: স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী এক ভূখণ্ড
তিব্বত, বর্তমানে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হলেও, একসময় এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১৯১২ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিব্বত মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে চাইনিজ লিবারেশন আর্মি তিব্বত দখল করে। যদিও তিব্বতীরা কখনও চীনের এই দখল মেনে নেয়নি এবং আজও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আধ্যাত্মিক বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত তিব্বত, নোবেল বিজয়ী দালাই লামার নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সমর্থন চাইছে।
নিউট্রাল মরেসনেট: ক্ষুদ্র কিন্তু স্বতন্ত্র এক দেশ
নিউট্রাল মরেসনেট নামের দেশটি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। মাত্র এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে থাকা এই ক্ষুদ্র দেশটি ১৮১৬ সালে গঠিত হয়। ডাচ ও প্রুশিয়ানরা যৌথভাবে জিঙ্কের খনি ব্যবহারের জন্য এই ভূখণ্ডকে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করে। দেশটির নিজস্ব পতাকা, মুদ্রা এবং এস্পেরান্তো নামে একটি ভাষাও ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এই দেশটি বেলজিয়ামের অংশ হয়ে যায়। বর্তমানে স্থানীয়রা প্রতিবছর নিউট্রাল মরেসনেটের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করে।
পারস্য: ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য
পারস্য ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে রাজা দ্বিতীয় সাইরাস পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ইউরোপের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণে সাম্রাজ্যটির পতন ঘটে। পারস্য নামটি ১৯৩৫ সালের আগপর্যন্ত ব্যবহৃত হতো; বর্তমানে দেশটি ইরান নামে পরিচিত। পারস্যের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এখনও ইরানের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
আবিসিনিয়া: ইথিওপিয়ার প্রাচীন পরিচয়
আবিসিনিয়া হলো ইথিওপিয়া দেশের পুরোনো নাম। এটি একসময় প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। বিদেশি শক্তি কখনোই আবিসিনিয়াকে দখল করতে পারেনি, যা আফ্রিকার গুটিকয়েক স্বাধীন দেশের মধ্যে এটিকে অনন্য করে তুলেছে। উনিশ শতকে ইতালির আক্রমণ সত্ত্বেও তারা তাদের স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ এই ভূখণ্ডকে ইথিওপিয়া হিসেবে ঘোষণা করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের ফসিল ইথিওপিয়া থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে।
নিউফাউন্ডল্যান্ড: এক সময়ের স্বাধীন দ্বীপ রাষ্ট্র
উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত বৃহৎ দ্বীপ নিউফাউন্ডল্যান্ড ১৯০৭ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। দ্বীপটির অর্থনীতি মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে দ্বীপটির জনগণ ব্রিটিশ কলোনির অংশ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৯ সালে ভোটাভুটির মাধ্যমে এটি কানাডার সঙ্গে চিরতরে যুক্ত হয়। বর্তমানে এটি কানাডার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ।
সিকিম: স্বাধীনতা থেকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়া এক দেশ
সিকিম ১৬৪২ সালে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৬১ সালে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করদরাজ্যে পরিণত হয়। এরপর ১৯৭৫ সালে সিকিমের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং এটি ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
চেকোস্লোভাকিয়া: ১৯১৮ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চেকোস্লোভাকিয়া মধ্য ইউরোপের একটি দেশ ছিল। ১৯১৮ সালের ২৮ অক্টোবর দেশটি তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে চোকেস্লোভাকিয়া ভেঙে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
প্রুশিয়া: আধুনিক ইউরোপের একটি ভিত্তি
আধুনিক জার্মানি ও পোল্যান্ড, রাশিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, লিথুনিয়া, অষ্ট্রিয়ার, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সের কিছু অংশের সমন্বয়ে গঠিত ছিলো প্রুসিয়া । ১৮৭১ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত অস্তিত্ব ছিলো দেশটির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন: এক সময়ের পরাশক্তির পতন
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি একদলীয় সাম্যবাদী রাষ্ট্র, যার অস্তিত্ব ছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালে ভেঙে যাবার আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ঐক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সরকারের পতনে, ১৫টি নতুন প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। যেগুলোকে বলা হয় কমনওয়েলথ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস বা সিআইএস
যুগোস্লাভিয়া: এক রাষ্ট্র থেকে ছয়টি দেশ
১৯১৮ সালে দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়া-হার্জেগোভিনা মিলে গঠন করে নতুন রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়া। যুগোস্লাভিয়া নামের অর্থ দক্ষিণ স্লাভদের দেশ। পূর্ব ইউরোপের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বৃহত্তর স্লাভ জাতির অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির কাছে পরাজিত যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের পরে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পরে নব্বইয়ের দশকে একে একে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া আর স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ নাম নিয়ে কিছুকাল টিকে থাকলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে গেলে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি।
সূত্র:https://www.youtube.com/watch?v=n5xAbXhYckk
আফরোজা