ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৪ মাঘ ১৪৩১

ভালোবাসার ভিত

সালাম হাসেমী

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

ভালোবাসার ভিত

দোলা রিকশা থেকে নেমে বোশেখের দগ্ধ দুপুরে মতিঝিল  ‘রায়হান গ্রুপ’ অফিসের সামনে এসে থামে। গায়ে ব্লাউজের সঙ্গে ম্যাচ করা  আকাশি রঙের শাড়ি, কানে দুল, গলায় সোনার চেইন, হাতে আংটি, ঠোঁটে  লিপস্টিক।  রুমাল দিয়ে  মুখের ঘাম মুছতে মুছতে  দাঁড়িয়ে অফিসের সাইন বোর্ড  পড়ে। বেশ কয়েকবার পড়ে। তার পরে মনে মনে ভাবে এটাই রায়হানের কোম্পানি হবে।  রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে হলে এখানেই যেতে হবে। অফিসটি দশতলা। বিশাল বড় গেট। সামনে দাঁড়িয়ে দাড়োয়ান। দোলা ধীরে ধীরে গেটের সামনে যায়। দাড়োয়ানের হাতে একটি ভিজিটিং কাড দিয়ে বলে-
: ‘আপনাদের কোম্পানির মালিক রায়হান সাহেবের হাতে  এ কাডটি দিয়ে বলুন যে একজন  ভদ্র  মহিলা অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে  আছে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
: আমাদের সাহেব যখন তখন কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি পরে আসুন।
: তিনি আমার বিশেষ পরিচিত। তার সঙ্গে আমার দেখা করা বিশেষ প্রয়োজন। ভিজিটিং কাড দেখলেই তিনি আমাকে চিনবেন।
দাড়োয়ান কয়েকবার দোলার দিকে তাকিয়ে মাথা হতে পা পর্যন্ত পরখ করে সাহেবের পিয়ন জলিলকে টেলিফোনে ডাকল। জলিল এলে তার  হাতে দোলার ভিজিটিং কাড দিয়ে বলল যে, এ কাডটি বড় স্যারের নিকট দাও। এ ভদ্রমহিলা স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। জলিল কাডটি নিয়ে স্যাারের হাতে দিলে রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার কাডটি পড়লেন তার পরে অস্পষ্ট করে কয়েকবার ‘দোলা’ শব্দটি উচ্চারণ করে জলিলকে বললেন , ‘আসতে বলো’। জলিল গেটে এসে দোলাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আসুন স্যার আপনাকে যেতে বলেছেন।’ দোলা জলিলের পিছু পিছু হেঁটে লিফটে  করে ছ’ তলায় গিয়ে রায়হান সাহেবের রুমে প্রবেশ করলে রায়হান সাহেব চোখ তুলে  আগন্তুক মহিলাকে ভালো করে পরখ করে ধীর গলায় বললেন
: বসুন। অপনাকে তো চিনতে পারলাম না। আপনার পরিচয় দিন।
: আমি দোলা। আমার বাড়ি কাশদোলা গ্রামে। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। আমার বাবা সাজ্জাদ চৌধুরী। আমি পিতার একমাত্র সন্তান। আপনার বাড়ি তো  কাশদোলা গ্রামে?
: না। আমার বাড়ি কাশদোলা গ্রামে নয়। আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না। আমার কাছে কি  জন্য আসছেন?
: আপনি আমাকে চিনেও  না চেনার  ভাব করছেন। আপনি কাশদোলা গ্রামের সাজ্জাদ চৌধুরীকে চিনেন না? আপনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন।
: রাগবেন না। কি খাবেন, ঠান্ডা না গরম?
  রায়হান সাহেব কলিং বেল টিপলেন। পিয়ন জলিল এলো। তাকে বলল,
: মেহমানকে একটি ঠান্ডা এনে দাও।
 জলিল একটি কোকাকোলার বোতল প্লেটে করে মেহমানের সামনে রাখল।
: বলুন, আর কি বলবেন?
: না। আপনার সঙ্গে আমার কথা বলার আর ইচ্ছে নেই। কারণ আপনার জন্ম যে কাশদোলা গ্রামে। যেখানে আপনার শৈশব কাল, কিশোর কাল ও  যৌবনকাল কেটেছে। আজ আপনি সে কাশদোলা গ্রাম চিনছেন না! ধন্যবাদ আপনার রূপ বদলকে। ধন্যবাদ আপনার জন্মভূমিকে ভুলে যাওয়াকে।  যে তার জন্মভূমিকে ভুলে যায়, তার ভিতরে তো দেশাত্মবোধ নেই। সে দেশের পরগাছা।
: চিনি না তা নয়। দোলা, কাশদোলা গ্রাম, সাজ্জাদ চৌধুরী এরা আমার স্মৃতি। দোলা ও সাজ্জাদ চৌধুরী আমার হৃদয়ের মাঝে ক্ষত। এ ক্ষত কখনো সেরে ওঠার  নয়। এ ক্ষত আজীবন থাকবে। তুমি আমি কাশদোলা গ্রামে একই পাইমারী স্কুলে পড়তাম। সেই শৈশবকাল থেকেই আমরা দুজন দুজনাকে ভালোবাসতাম। তুমি লুকিয়ে  লুকিয়ে তোমার বাড়ির আম, জাম, কাঁঠাল  ও নানা ধরনের খাবার এনে মাকে খাওয়াতে। আরো কত কি। তা বলে শেষ করা যায় না। দুজনে প্রাইমারী পাস করে  হাইস্কুলে উঠলাম। এসএসসি পাস করে আমরা জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। এইচএসসি পাস করে তুমি জেলা শহরের কলেজে অনাসে ভর্তি হলে। আমি ঢাকা শহরে  এসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি হলাম।  এদিকে তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন। তুমি বিয়ে করতে রাজি না হলে তোমার বাবা খোঁজ খবর নিয়ে যখন জানতে পারলো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমাদের দুজনের প্রেমের কথা শুনে তিনি দেখলেন যে আমি হলাম গরিব দিনমজুরের ছেলে আমার সঙ্গে বিত্তবান চৌধুরী বংশের মেয়ের  বিয়ে হতে পারে না। তখন তিনি নতুন ফন্দি আঁটলেন। আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দিবে বলে তোমাকে দিয়ে ঢাকা থেকে  আমাকে বাড়িতে ডেকে আনলেন। তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে বললে তুমি। আমি দেখা করলাম। তিনি আমাকে শাসিয়ে বললেন তুমি দোলাকে ভুলে যাও। নতুবা তোমাকে আজীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। কোনো দিন হাজতখানা হতে  বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমি তাঁর কথায় রাজি হলাম না। আমি বললাম যে আমি দোলাকে ভুলতে পারবো না। তার দুদিন পরেই আমি হত্যা  মামলার আসামি হয়ে জেলখানায় চলে গেলাম। জেলখানা থেকে শুনতে পারলাম যে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। সাত বছর হাজত খাটার পরে  মামলা থেকে খালাস পেলাম। খালাস পেয়ে আমি আর বাড়ি গেলাম না। সরাসরি ঢাকায় চলে এলাম। পড়ালেখা আর হলো না। মনে মনে ভাবলাম যে  টাকা আয় করে জীবনে বড় ধনী হতে হবে। সাজ্জাদ চৌধুরীর চেয়ে বড় ধনী। ছোটখাটো ব্যবসা করতে শুরু করলাম। ছোট ব্যবসা করতে করতে আমি বড় ব্যবসায় পা রাখলাম। এখন আমি বড় ব্যবসায়ী।
: আমি তো আর ইচ্ছে করে বিয়ে করিনি। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
: আমি তোমাকে পালিয়ে বিয়ে করতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাইলে না। এখন তো তুমি সুখেই আছো। আমার দুঃখ দেখার জন্য আমার অফিসে চলে এসেছো।
: তুমি তো শুধু আমার সুখই দেখলে। জানতে চাইলে না আমি কেমন আছি।
 বলে দোলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তখন রায়হান সাহেব দোলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,
: তুমি আসলে কেমন আছো? তুমি কাঁদছো কেন?
: বিয়ের দুবছর পরে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার এক বছর পরে আমার বাবা মারা যায়। তার কিছুকাল পরে দেখলাম বিধবার একাকী জীবন ভালো লাগছে না। তখন আমি আমার মামার সহায়তায় ঢাকার একটি স্কুলে চাকরি পাই সে চাকরি করে জীবন নির্বাহ করছি। ঠিক সে মুহূর্তে রায়হান সাহেবের পিএস নবিতা এসে বলল
: স্যার  ম্যানাজার স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন।  জেনারেল মিটিং শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে যেতে বলেছেন।
: ম্যানাজার সাহেবকে বলো যে, আমার শরীর আজ ভালো লাগছে না। আজ মিটিং  হবে না। আগামীকাল হবে। আমি এখন বাসায় যাব। ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলো। দোলা চলো আমার বাসায়। কয়েক দিন বেড়াবে।
দোলা রায়হান সাহেবের সঙ্গে তার গাড়ি করে বাসায় চলে গেল। রায়হান সাহেব পোশাক বদলিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসলেন। দোলাও হাত মুখ ধৌত করে খাওয়ার টেবিলে এসে বসল। বাড়ির বাবচি খানা পরিবেশন করল। ভোজন শেষে রায়হান সাহেব দোলাকে একটি কক্ষ দেখিয়ে সেখানে বিশ্রাম নিতে বলল। নিজে গিয়ে তার কক্ষে বিশ্রাম করতে লাগল। দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। রোদ্র পড়ে আসলে দোলা ও রায়হান সাহেব ছাদে গিয়ে বসল। তখন দোলা রায়হান সাহেবকে প্রশ্ন করল,
: রায়হান তোমার স্ত্রী কোথায়? বাবরচি খাবার পরিবেশন করল।
: আমি তো বিয়েই করিনি।
: কেন বিয়ে করোনি?
: আমি যদি এখন বিয়ে  করতে  চাই তা হলে এদেশের একজন ধনী লোক আমাকে তার কন্যার সঙ্গে  বিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু এই আমি যদি গরিব হই তা হলে ওই ধনী লোক আমার সঙ্গে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। সেই জন্য আমার ধারণা মানুষ কখনো মানুষকে ভালোবাসে না। মানুষ ভালোবাসে তার অর্থ সম্পত্তিকে। অর্থ সম্পত্তি না থাকলে তাকে কেউ ভালোবাসে না। তাই বলা যায় ভালোবাসা হলো অর্থের দণ্ডের ওপর দাঁড়ানো। অর্থ ছাড়া শূন্য হৃদয়ের ওপর ভালোবাসা  দাঁড়াতে পারে না। আমার যদি প্রথম জীবনে অর্থ সম্পত্তি থাকতো তবে  তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হতো। আমাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেতো না। আমাকে তোমার বাবা মিথ্যা মামলায় সাত বছর হাজত খাটাত না। যে কারণে আমি বিয়ে করতে চাই না। এ জগতে যতদিন বেঁচে আছি ততদিন শুধু অর্থ আয় করে যাব। অর্থ-শূন্য আমাকে কেউ ভালোবাসে না। ভালোবাসে আমার অর্থ সম্পত্তিকে। শূন্য হৃদয়ে যদি ভালোবাসা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো তবে আমি একজন নারীকে বিয়ে করে ঘর করতাম।
 ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম আকাশে পাটে বসেছে। ছাদের ওপর আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। রায়হান সাহেব ছাদ থেকে  নিচে নামার জন্য উদ্যত হয়েছেন ঠিক সে সময় দোলা রায়হান সাহেবের হাত ধরে বলল,
: শোনো রায়হান, দোষ যা করার আমার বাবা তার অর্থের অহংকারে করেছে, আমি তো করিনি। সব দোষের কথা ভুলে গিয়ে এখন আমরা  সংসার করতে পারি না?
: না দোলা।  তা হয় না। তখন আমি কপর্দক শূন্য হৃদয়ে তোমার হৃদয়ের ওপর  দাঁড়াতে পারিনি, এখন আমার  অর্থ হয়েছে, পায়ের নিচে  ভিত হয়েছে, এ ভিতের চাহিদা সকলের কাছে। ভিতের চাহিদা সকলের থাকবে কিন্তু এখান আমি কাউকে এ ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেব না। ভালোবাসা দাঁড়ায় ভালোবাসার ভিতের ওপর। আমার  হৃদয়ে তো এখন আর ভালোবাসা নেই। আমার ভালোবাসা তোমার বাবার অর্থের নিচে চাপা পড়ে দলিত হয়ে  মরে  গেছে।
রায়হান সাহেবের কথা শুনে দোলা আঁচলে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদল।
তার পরে অনেকক্ষণ রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।

×