ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৪ মাঘ ১৪৩১

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

ড. জাকিয়া বেগম

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

অনেকের কাছেই ‘আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে যেন! তাদের ধারণা মানুষের তৈরি এই রোবটগুলো একদিন মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করবে, এই পৃথিবীর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেবে এবং মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে! তবে সত্যিই কি ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ একদিন পৃথিবীর সব কর্মকাণ্ড নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসে পুরো পৃথিবীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে! আসুন সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
বহু যুগ ধরেই বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকরা মানুষের মতো চিন্তা করতে সক্ষম এমন মেশিন তৈরির ব্যাপারে আলোকপাত করে আসছিলেন যা বাস্তব রূপ লাভ করে ১৯৯৭ সালে যখন মানুষের বিপরীতে দাবা খেলার জন্য নকশাকৃত আইবিএম কর্তৃক প্রোগ্রামকৃত ডিপ ব্লু নামের কম্পিউটারটি দাবা খেলায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জিএম গ্যারি কারস্পারভকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। তাই ডিপ ব্লুর বিজয়কে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-এর ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর থেকে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ তথা কম্পিউটারের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ অতি উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র যা সংখ্যা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পূর্বে প্রোগ্রামকৃত ‘সফ্টওয়্যার’-এ নির্দেশিত কার্যধারাসমূহ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সংযোজিত ও প্রয়োজনীয় ‘হার্ডওয়্যার’-এর সাহায্য নিয়ে মানুষের বোধশক্তি দ্বারা পরিচালিত সব ধরনের কর্মকাণ্ড যেমন, বিভিন্ন প্রাকৃতিকভাষা শোনা ও প্রক্রিয়াকরণ, কথা ও বক্তৃতার ব্যাখ্যা করা, গেম খেলা এবং বিভিন্ন ধরনের ছবি এবং নকশার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় বা কোনো ঘটনা ঘটার সময়কার তথ্য অনেকটা মানুষের মতো করেই তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করতে পারে এবং তদনুযায়ী প্রতিক্রয়া দেখাতে বা তথ্য সরবরাহ করতে পারে বা সমস্যার সমাধান প্রদান করতে পারে।
সাধারণ কম্পিউটারের ‘সফ্টওয়্যার’-কে সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক কাজ সম্পন্ন করার মতো করে প্রোগ্রাম করা হয়। এক্ষেত্রে এগুলো ইনপুট ডাটা এবং সফ্টওয়ারে কোডের আকারে সন্নিবেশিত কিছু নির্দেশনা মেনে ‘আউটপুট’ বা ফলাফল প্রকাশ করে কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-এর যন্ত্রগুলোতে অসংখ্য সংখ্যক তথ্য বা ডাটা সংরক্ষিত করা থাকে। এই ডাটা লিখিত কোনো সংখ্যা, শব্দ, বাক্য ছাড়াও ছবি, বক্তৃতা ইত্যাদি যে কোনো ধরনেরই হতে পারে। মানুষ যেভাবে শেখে ‘এআই’ যন্ত্রগুলোকেও এ্যালগোরিদমের সাহায্যে ডাটাগুলোকে বিশ্লেষণ করেকিভাবে নির্ভুল ‘আউটপুট’ বা তথ্য প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়।
কোনো তথ্য বা ঘটনা সম্পর্কে ধারণা লাভ করার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন; ছোটবেলা থেকেই অসংখ্য বার আমরা দেখে এসেছি, যে ছাত্র/ছাত্রীটি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে না সে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না। এই পরিসংখ্যান সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার তথ্যটি আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করে আছে। তাই এখন পড়াশোনায় কম মনোযোগী কোনো ছাত্রছাত্রী দেখলেই আমরা তার পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে ধারণা করতে পারি। ঠিক একইভাবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-এর যন্ত্রগুলোকে পরিসংখ্যান সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মানুষের মতো করে তথ্যসমূহ এবং তথ্যসমূহের গভীর পর্যন্ত দেখতে, বুঝতে এবং মনুষ্য রচিত ‘সিরিজ এলগোরিদম’ অর্থাৎ পর পর সাজানো কতকগুলো এলগোরিদম (একটি গণনার পদ্ধতি)-এর সাহায্যে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখাতে শেখানো হয়। এক্ষেত্রে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য সংখ্যক তথ্য প্রক্রিয়াজাত ও বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কোনো বস্তু, নক্শা বা ঘটনা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে, তথ্যগুলো ‘পরীক্ষা এবং ত্রুটি’ পদ্ধতির দ্বারা (ট্রায়াল এবং এরর বেসিসে) বিশ্লেষণের মাধ্যমে অধিক গ্রহণযোগ্য কোনো সিদ্ধান্ত বা ইতিবাচক ফলাফলে পৌঁছায় এবং যে লক্ষ্য নিয়ে যন্ত্রটি তৈরি করা হচ্ছে সে অনুযায়ী ফলাফল প্রকাশ করে অথবা সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। কোনো নতুন তথ্যের সম্মুখীন হলে কম্পিউটারটি এভাবেই নিজস্ব ‘ডাটাবেজ’-এ সংরক্ষিত বিভিন্ন তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখে এবং তার প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত কোড লাইনের নির্দেশনা মেনে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য একটি ইতিবাচক ফলাফল প্রকাশ করে।
 যেহেতু ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’কে অসংখ্য তথ্যকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে কার্যসম্পাদনে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয় তাই যত বেশি সংখ্যক ডাটা ‘ইনপুট’ হিসেবে সরবরাহ করা হয় ‘আউটপুট’ ততই নির্ভুল হয়ে ওঠে। প্রকাশিত নতুন তথ্যগুলোও সে তার ‘ডাটাবেজ’-এ সংরক্ষণ করে রাখে। এভাবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ‘ডাটাবেজ’ দিন দিন সমৃদ্ধশালী হতে থাকে। আবার এ ধরনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যদি কোনো ভুল হয় তবে সেই ভুলের তথ্যও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য ‘ডাটাবেজ’ এ সংরক্ষণ করে রাখে।
প্রোগ্রামারের সরাসরি কোনো নির্দেশনা ছাড়া এভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক তথ্য চিহ্নিত করা, অংকের বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করে মানুষের অনুকরণে বিশ্লেষণ করে ‘আউটপুট’ প্রদান করা এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চালু রেখে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠার পদ্ধতিকে ‘যান্ত্রিক শিক্ষা (মেশিন লারনিং)’ বলা হয়।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-এর যন্ত্রগুলোকে আরও গতিশীল ও নির্ভুল ফলাফল দিতে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে তথ্য সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মেশিন লারনিং-এরই অন্তর্ভুক্ত আরও একটি উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যাকে বলা হয় ‘ডিপ লারনিং’ অর্থাৎ ‘গভীর জ্ঞানার্জন বা শিখন’। ‘গভীর শিখন’ হলো মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের আদলে কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন স্তর তৈরি করে (কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক)-এর মাধ্যমে ডাটা সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে নিজস্ব ধারায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন। সাধারণভাবে ‘মেশিন লারনিং’ যেখানে ‘সিরিজ এলগোরিদম’-এর সাহায্যে পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে ‘আউটপুট’ বা তথ্য প্রদান করে ‘ডিপ লারনিং’ সেখানে কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্রের ন্যায় বিভিন্ন স্তরের উন্নত এ্যালগোরিদম ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে জটিল ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি একক, সঠিক এবং তাৎক্ষণিকভাবে (রিয়েল টাইম-এ) যুক্তিসঙ্গত আউটপুট নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জন করে। ফলে এই যন্ত্রগুলো কোনো বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক ভাষা তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বোধগম্য করে তুলে তা আবার ভাষায় প্রকাশ করতে পারা, কোনো ধরনের ছবি, নকশা, বক্তৃতা আলাদাভাবে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করতে পারা ইত্যাদি জটিল ধরনের কাজ সম্পাদন করতে পারে। ‘ডিপ লারনিং’ ‘মেশিন লারনিং’-এরই অন্তর্ভুক্ত তবে সব ‘মেশিন লারনিং’ ‘ডিপ লারনিং’ নয়।
অসংখ্য ডাটা বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ এবং সেইসঙ্গে ‘ডিপ লারনিং’ পদ্ধতির ব্যবহারই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র যন্ত্রগুলোর প্রভূত অগ্রগতি সাধন করে চলেছে। এদের যৌক্তিকতা বিচারের ক্ষমতাও এতটাই বৃদ্ধি করা হয়েছে যে এরা ‘ডাটা বেজ’-এ সংরক্ষণ করা নাই বা বিশেষ একটি তথ্যের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নাই এমন কিছু নতুন তথ্যও নিজস্বভাবে চিহ্নিত, বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী ’আউটপুট’ প্রদান করতে সক্ষম হয়ে ওঠে যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ‘স্বচালিত গাড়ি’ এবং ‘চ্যাটজিপিটি’।
বেশি সংখ্যক ডাটা সংরক্ষণ এবং এগুলোর সঠিক মূল্যায়নের জন্য কোডে যত বেশি নির্দেশনা সংযোজন করা হয় ‘এআই’ যন্ত্রগুলো কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে তত ধীরগতির হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই  প্রোগ্রামগুলোকে দ্রুত ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এবং নির্ভুলভাবে পরিচালনার জন্য যন্ত্রগুলোতে বিশেষ ধরনের শক্তিশালী হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হয়। বিশেষভাবে তৈরি চিপস্ এবং ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের সমন্বয়ে তৈরি হার্ডওয়্যারগুলোর কাজ হলো ডাটা সংরক্ষণ, দ্রুতগতিতে নির্দিষ্ট ডাটা চিহ্নিতকরণ, প্রয়োজন অনুযায়ী এ্যালগোরিদমের সাহায্যে ডাটা বিশ্লেষণ ত্বরান্বিত করা ও সফট্ওয়্যারের নির্দেশিত কোডগুলো অতি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা। ‘কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক’ প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি (নিউরাল প্রসেসিং ইউনিট) পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও হার্ডওয়্যারই সম্পন্ন করে থাকে। আর কম্পিউটারের ‘মগজ’ হলো ‘সিপিইউ’ বা কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ অংশ যা বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে সমগ্র কার্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। মেশিন লারনিং বা ডিপ লারনিং পদ্ধতির জন্য নিজস্ব কার্য পদ্ধতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সফট্ওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হয়।
যন্ত্রগুলো পরিচালনার জন্য শক্তি সরবরাহ করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শক্তির উৎস হিসেবে সাধারণত বিদ্যুৎ, রাসায়নিক বা সোলার ব্যাটারি ব্যবহার করা হয় তবে অন্য যে কোনো ধরনের শক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। যন্ত্রটির শক্তির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা নির্ভর করে কাজের পরিমাণ, দ্রুততা বা জটিলতার ওপর। এক্ষেত্রে যন্ত্রটি পরিচালনের জন্য কি পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে হবে তা বিশেষ গুরুত্ব সহকারেই বিবেচনা করা হয়। কারণ শক্তি খরচের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটি পরিচালনা খরচও বৃদ্ধি পায়।
প্রদত্ত নির্দেশনা সঠিক থাকলে ‘এআই’ যন্ত্রগুলোর ত্রুটির হার মানুষের তুলনায় কম, মানুষের ক্ষেত্রে কোনো জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যাটি বুঝতে এবং প্রক্রিয়াজাত করে সঠিক সমাধানে পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগে কিন্তু প্রদত্ত ডাটা থেকে ‘এআই’ দ্রুততার সঙ্গে নির্ভুল ফলাফল জানাতে পারে। মানুষের জন্য দুর্ঘটনাপ্রবণ বা বিপজ্জনক এমন অনেক কাজ ‘এআই’ দ্বারা সম্পাদন করা যায়, ক্লান্তিকর বা পুনরাবৃত্তিমূলক কাজে মানুষ বিরক্ত হয়ে পড়লেও ‘এআই’ কখনও বিরক্ত হয় না এবং এদের বিশ্রামের প্রয়োজন না থাকায় দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে যেতে পারে।
সুবিধার পাশাপাশি ‘এআই’ ব্যবহারের কিছু অসুবিধাও আছে। এগুলো তৈরি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রটি এখনও বেশ ব্যয়বহুল। ‘এআই’ এর সক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য ব্যবহৃত ‘ডাটা’, বেশকিছু গাণিতিক এ্যালগোরিদম্, কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের ওপর নির্ভরশীল এবং এর বাইরে কোনো কার্য সম্পাদন করার ক্ষমতা তার নেই। বুদ্ধিমত্তা এবং সৃজনশীলতা না থাকায় পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে ডাটা এবং নির্দেশনার অল্প বিচ্যুতি হলেই এরা সঠিক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়। সৃজনশীলতা না থাকায় সত্যিকার অর্থে ‘এআই’ নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে না যদিও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে এবং সন্নিবেশিত ‘ডাটা’র আলোকে নতুন কিছু ধারণা বা প্রস্তাবনা তুলে ধরতে পারে কিন্তু তা কখনই মৌলিক হতে পারে না।  
‘এআই’-এর ব্যবহার মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তাকে ঝুঁকির সম্মুখীন করে তুলেছে, ভোক্তারা বিভিন্ন প্রতারণার শিকার হচ্ছে, মানুষের চেহারা ও গলার স্বর নকল করার মাধ্যমে অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে বড় বড় অর্থনৈতিক ও ব্যাংক কেলেঙ্কারি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের ব্যবহারের ব্যাপারে নৈতিকতার প্রশ্নও দেখা দিতে পারে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ যতই শক্তিশালী হয়ে উঠুক না কেন এগুলো এখনো মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি কারণ কোনো কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে মানুষ তার মস্তিষ্কে সংরক্ষিত তথ্যসমূহের আলোকে অর্জিত স্মৃতি, পূর্ব অভিজ্ঞতা, প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা এবং জ্ঞানীয় প্রতিভা, আবেগ, ব্যক্তিগত পছন্দ, সাংস্কৃতিক প্রভাব ইত্যাদির আলোকে বিষয়কেন্দ্রিক সমাধান প্রদান করে। মানুষ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো শুধুই নকশা বা সংখ্যা তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল নয় তাই যখন মাল্টিটাস্কিং, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং আত্ম-সচেতনতার কথা আসে, তখন মানুষ অনেক বুদ্ধিদীপ্ত সমাধানে উপনীত হতে পারে। কিন্তু ‘এআই’ এর অগ্রগতিগুলো সংখ্যাসূচক চক্র দ্বারা নির্ধারিত হয়। ‘আইকিউ’ না থাকায় যন্ত্রগুলো অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিমূর্তভাবে চিন্তা করতে পারে না, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সম্পূর্ণরূপে তথ্যসমূহের পর্যাপ্ততা, এ্যালগোরিদম্, সামঞ্জ্যপূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান এবং মানুষের দ্বারা সেট করা কোডের নির্দেশনার ওপর নির্ভরশীল। তাই সমস্যার সমাধান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় বস্তুনিষ্ঠ।
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ অনেক ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা সমাধানে পারদর্শী হলেও সমাজ-সংসারের অনেক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি এবং সৃজনশীলতার প্রয়োজনীয়তা অনিস্বীকার্য। সাধারণ জ্ঞান, সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, কল্পনা, উৎসাহ ইত্যাদি গভীর অনুভূতিগুলো মানুষের জন্যই একচেটিয়া। মানুষ তার অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তার দ্বারা যে কোনো ঘটনা বা সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা করে সে অনুযায়ী প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম যা একটি যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের মস্তিষ্কের কার্য পদ্ধতি এতটাই জটিল যে তা এখনো বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করে উঠতে সক্ষম হননি। তাই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা পদ্ধতি ভবিষ্যতেও হুবহু অনুকরণ করা আদৌ সম্ভবপর হয়ে উঠবে কি না সে বিষয়ে প্রচুর সন্দেহ রয়েছে।
তাই বলা যায় ভবিষ্যতেও ‘এআই’ মানুষের জন্য একটি অতি মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র হয়ে উঠে মানুষের দক্ষতা বহুগুণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে ঠিকই কিন্তু তা কখনই মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না এবং ভবিষ্যতে এদের দ্বারা মনুষ্যজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রযুক্তি মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে বলে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। অতীতে দেখা গেছে কখনো কোনো প্রযুক্তি এককভাবে অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। আরও অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, গত দশকে উন্নত বিশ্বে বেকারত্বের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। যেসব দেশে অটোমেশন ও রোবটিকসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, যেমনÑ জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সেসব দেশে বেকারত্ব সবচেয়ে কম। কারণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো কিছু পেশার প্রয়োজন কমে গেলেও নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে।
বিশ্ববিখ্যাত সফটওয়্যার বিকাশকারী ও ধনী ব্যবসায়ী ‘বিল গেটস্’ বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই একমাত্র প্রযুক্তি’ না যা বিশ্বের শ্রম বাজারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে; এর আগেও বিভিন্ন প্রযুক্তি বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলেছে। শ্রমবাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবও অবশ্যই পড়বে তবে তা ‘শিল্পবিপ্লব’-এর ন্যায় অতটা নাটকীয় হবে বলে মনে হয় না যেমন ‘ওয়ার্ড প্রসেসিং’-এর ব্যবহার অফিসের কাজকে বাতিল করে দেয়নি বরং সহজ করে তুলেছে এবং মানুষও এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন ‘এই প্রযুক্তি যেন মানুষের জীবন ও জীবনযাত্রাকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলতে না পারে মানুষকেই সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন মানুষ এই পরিবর্তনকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে এবং এই প্রযুক্তির খারাপ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখে ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে সক্ষম হবে।’
পরিশেষে বলা যায় কোনো প্রযুক্তি মনুষ্যজাতির জন্য শুভ না অশুভ হবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে মানুষের সৎ বা অসৎ উদ্দেশ্যের ওপর। তেমনি ‘এআই’ কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে তাও মানুষ কর্তৃকই নিয়ন্ত্রিত হবে। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত অবিকল মনুষ্য বুদ্ধিসম্পন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তৈরি করা কাল্পনিক পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং বৃহৎ আকারের জরিপের ফলাফলওÑ এটাই বলে যে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন যে যতই উচ্চ শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘এআই’ যন্ত্র তৈরি করা হোক না কেন মনুষ্যসদৃশ যন্ত্রদানব তৈরি করা আদৌও সম্ভব হবে না।

×