সমাজের সমসংখ্যক নারীর পেছনে পড়া থেকে অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হওয়া এক অনধিগম্য যাত্রা। যে কোনো সময় কিংবা যুগেও এমন পশ্চাদবর্তিতা চিরায়ত এক বিধি তা বলাই যায়। বিভিন্নকালের যাত্রাপথে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশ যন্ত্রণার শিকার হওয়া যেন অলিখিত এক নিয়মবিধি। যা চিরায়ত অপসংস্কার বললে অত্যুক্তি হয়ই না। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির নতুন সময়েও এর ব্যত্যয় ঘটছে না। কমার লক্ষণও ক্ষীণ। আর নারীর প্রতি অসহিষ্ণুতা চিরকালের এক বিষণ্ন্নতার তিক্ত আবহ। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যাহ্নে তেমন মর্মস্পশী অঘটন আজও সংশ্লিষ্টদের দুর্বল করে দিচ্ছে। যেখানে সমসংখ্যক নারী সুযোগ-সুবিধায় এগিয়ে চলার সুবর্ণ সময়ে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। সেটা দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান এক লাগাতার পশ্চাদবর্তিতার আবর্ত। আর শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ নারীদের দুরবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ভাবাও যায় না। হরেক বিঘ্নতায় সমাজ সংস্কার নতুন সময়ে আধুনিক যাত্রা যেমন দেখে পাশাপাশি অনেকেই আবার অন্ধকারের পথে কোনো আলোর ছটা না পাওয়াও নিতান্ত দুর্বিষহ অবস্থা। অত্যাচারিত মানসিক কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীর ওপর বিভিন্ন সময় গোলটেবিল বৈঠকে আলাপ-আলোচনা সভা বসলেও ন্যায্যতার কোনো সুনির্দিষ্ট যাত্রাপথ অবারিত হচ্ছে না বলে বহু গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসছে। সমস্যা শুধু মাঠে-ময়দানে বক্তৃতা কিংবা বৈঠকের মধ্যে শেষ হওয়ার বিষয় নয়। যথার্থ কর্মযোগে কার্যকরী ভূমিকাও পরিস্থিতির অপরিহার্যতা। তবে গোলটেবিল আলোচনায় সুহৃদ, সুধীজন কিন্তু বাস্তব কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন যা সমস্যা চিহ্নিত কিংবা নিরসনেও যৌক্তিক সমাধান দিতে পারে।
তবে সমাধান দিতে নারী নেত্রীরা কসুর করছেন না। কিন্তু বাস্তব কার্যক্রমে তার কোনো ছায়া কিংবা ছোঁয়াটিও থাকে না। তবে সম্প্রতি উঠে আসে আর এক অসহনীয় চিত্র। প্রতিবন্ধী নারী সবাই কর্মক্ষেত্রের জন্য অযোগ্যও বিবেচিত হন না। কিন্তু বলা হচ্ছে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও কোনো অদৃশ্য কারণে তাদের কর্মযোগে যুক্ত হতে না পারাও এক অযাচিত দুর্ভোগ। আমরা জানি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বই ছাপা হয়, যাতে স্পর্শ করেই তিনি ধরতে পারেন কোথায় কোন বর্ণ, শব্দচয়ন কিংবা বাক্য গঠনও তাকে শিক্ষার আলো দেখায়। যার কারণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতই শুধু নন বরং প্রাতিষ্ঠানিক কর্মযোগে গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করাও এমন লড়াকু নারীদের জীবনে প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি হাতের নাগালে এসে যায়। তবে কর্মক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে পরীক্ষায় যোগ্যতম বিবেচনা সত্ত্বেও চাকরি না পাওয়ার দুর্ভোগ সামনে এসে যাচ্ছে। শুধু চাকরি নয় সংসার চালানোর দায়-দায়িত্ব ও সক্ষমতা প্রমাণ করতে পিছু হটছেন না। কিন্তু কোথায় যেন গাফিলতি, বিঘ্নতা, অযোগ্য হিসেবে আড়চোখে অনেকের বিরাগভাজন হতেও সময় লাগে না। সেখানে যোগ্যতা নয় যেন করুনার দৃষ্টিতে অসহায় নারীকে রুদ্ধতার জালে আটকে দিয়ে বিদ্ধ করা সমাজ সংস্কারের অলিখিত, অযৌক্তিক শাস্তি দেওয়া।
কোন অপরাধ না করেও। সেই জন্মই আমার আজন্মের পাপ। যা কোনোভাবেই মুছে যাওয়ার বিষয়ই নয়। তবে সমাজের বহু সুহৃদয় ব্যক্তিদের গড়া প্রতিষ্ঠানে এসব প্রতিবন্ধী নারীর কাজ করার সুযোগ পাওয়া মুষ্টিমেয় কিছু মহান মানুষের উদারতা আর সচেতন অনুভব। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ কাউকেই সুযোগ না দেওয়ার তথ্য-উপাত্ত গণমাধ্যমের পাতা ভারি হয়। তবে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।
কিছুদিন আগেও আমি মানিকগঞ্জের কাবেরি নামে এক শারীরিক প্রতিবন্ধীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসি। তার থেকে জানতে পারি মায়ের কারণেই তিনি লেখাপড়া শুরু করে শেষ অবধি যেতে পেরেছেন মায়ের কোলে চড়ে। হাঁটতে পারতেন না। মা দীর্ঘদিন অন্য কোনো সন্তান নেননি কাবেরির জন্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) স্নাতকোত্তর করে সমাজসেবা অধিদপ্তরে কর্মকর্তার আসন অলঙ্কৃত করছেন। পারিবারিকভাবে মায়ের কারণেই তার এমন সফল কর্মযোগ। এখনো তার দাপ্তরিক কর্মক্ষেত্র সামলানো স্বতঃস্ফূর্ত আর সাহসিক মনোশক্তিতে। তাই কোনো অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা দৃষ্টিকটুভাবে অবলোকন নয়, রক্তে মাংসে যে কোনো মানুষ অনাকাক্সিক্ষত অঙ্গহানির জন্য পেছনে পড়ে থাকবে সেটা মানা সত্যিই কঠিন। যোগ্যতার মাপকাঠিতে সক্ষম, সামর্থ্য থাকলে যথাবিহিত তাকে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেয় এবং বিভিন্ন কর্মযোগে বঞ্চিত না করাও প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক ও সচেতন দায়বদ্ধতা তাদের নিয়ে সরব হচ্ছেন সমাজের বহু গুণীজন, হরেক প্রতিষ্ঠান এবং চারপাশের সহনীয় পরিবেশ ও অবারিত করতে হবে, যাতে পেছনে পড়ে থাকতে না হয়। তা অবশ্যই যোগ্যতম ও ক্ষমতাবান প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বিঘ্নতার দ্বার বিলোপ করা। প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়ে রাস্তাঘাটে যোগাযোগ মাধ্যম ও যাতায়াত ব্যবস্থাপনায়।
তাদের জন্য স্বাতন্ত্রিকভাবে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়তি সুযোগ-সুবিধায় সামনে আনা যায় কি না তা ভাবাও জরুরি। শুধু কি যোগাযোগ মাধ্যম? কর্মস্থলেও অসহায় প্রতিবন্ধী নারীর নানামাত্রিক হয়রানি ও অপদৃশ্য দৃষ্টির অন্তরালে থাকেও না। সুস্থ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পর্যায়ে তাদের জীবনযাত্রা সহনীয় ও অবারিত করতে হবে।
প্রতিবন্ধী নারীর চ্যালেঞ্জ
শীর্ষ সংবাদ: