.
পুরান ঢাকার আকাশে উড়ছে নানা রঙের ঘুড়ি, ঠিকানাবিহীন খোলা চিঠির শহর যেন রাজধানী। আলোর ঝলকানিতে ইটপাথরের নগরী পেয়েছে এক মোহময়রূপ। তবে নানা বিধিনিষেধের কারণে চারশ’ বছরের পুরনো সাকরাইন উৎসব এবার কিছুটা ঢিলেঢালা ছিল।
পৌষের বিদায় লগ্নে আনন্দে মেতেছে ঢাকাবাসী। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরই পুরান ঢাকার আকাশজুড়ে ছিল আলোর রোশনাই। ভবনের ছাদে ছাদে দেখা যায় আলোকসজ্জা। বাড়ির ছাদে ছাদে লাইট শো, ডিজে, আতশবাজি উৎসবের মূল আকর্ষণ। আতশবাজিতে ছেয়ে যায় রাতের আকাশ। এত আলোর কাছে শীত-কুয়াশা যেন নস্যি।
পুরান ঢাকার কোতোয়ালির একটি বাসার ছাদে সকাল থেকে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে সাজিদ। সঙ্গে তার চারজন বন্ধু। সকলে মেতেছে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায়। কে কাটবে কার ঘুড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাজিদের ঘুড়িটি অন্য ছাদের একজন কেটে ফেলায় সাজিদের বন্ধুরা তার ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতায় নামে। শুরু হয় একে অপরের ঘুড়ি কাটাকাটি। এভাবেই ঘুড়ি উড়িয়ে ও একে অপরের ঘুড়ি কেটে পুরোনো উৎসব পালন করেছে পুরান ঢাকাবাসী।
ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন ঘিরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন ছাদে এমন দৃশ্য খুবই পরিচিত ও সাধারণ। দিনটি কিছুটা আলোকোজ্জ্বল থাকায় আকাশে বাতাসে উড়তে থাকে রঙিন ঘুড়ি। গোটা পুরান ঢাকা পরিণত হয় ঘুড়ি উৎসবে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় ঘুড়ি উড়ানোর এই চিত্র এবার কম দেখা যায়। বাসার ছাদে আতশবাজি আর আলোর ঝলকানি থাকলেও ছিল তুলনামূলক কম।
ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে পৌষ মাসের শেষ দিনে পৌষ সংক্রান্তি পালন করা হয়। পুরান ঢাকায় যা সাকরাইন নামে পরিচিত। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বুড়িগঙ্গার তীরে ঘুড়ি উড়িয়ে এ উৎসব পালন করা হয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসবে কিছুটা ভাটা এবং ভিন্নতা এসেছে। ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় সাকরাইন উৎসবে সময় দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তবে সাকরাইন উৎসবের উৎসাহ-আমেজ ধরে রেখেছেন স্থানীয় তরুণ তরুণীরা।
এদিন শাঁখারি বাজারের সুভাসচন্দ্রের সঙ্গে আলাপকালে জানান, এবারের সাকরাইন তথা ঘুড়ি উৎসবের জন্য সে ও তার বোন দশটি ঘুড়ি কিনেছে। বিকেল পর্যন্ত সে অন্য ছাদের ৩টি ঘুড়ি কেটেছে। অন্যরাও তার ঘুড়ি কেটেছে কয়েকবার। তার সবচেয়ে পছন্দের ঘুড়ি পতেঙ্গা।
ছোটবোনের কথা জিজ্ঞেস করলে মুচকি হাসি দিয়ে তিনি বলেন, ও তো ছোট মানুষ। ছাদে নিয়ে না আসলে কান্না করে। তাই সঙ্গে নিয়ে আসছি। ওর জন্য আমার বেশি ঘুড়ি কাটা যাচ্ছে।
শুধু শাঁখারি বাজার নয়, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, কাঠের পুল, লোহার পুল, বংশাল, নয়া বাজার, রায়সাহেব মোড়, শিংটোলা, ইসলামপুর, ধূপখোলা মাঠসহ বিভিন্ন ছাদে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে ছেলেমেয়েরা। ব্যস্ততার কারণে সবার সঙ্গে না থাকলেও অনেকের সঙ্গে রয়েছেন অভিভাবক।
ছেলে-মেয়েদের ঘুড়ি উড়ানোর আবদারে ধূপখোলা মাঠে এসেছেন জুলফিকার মাহমুদ তিনি পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। কাজের ফাঁকে সময় বের করে তিনি সন্তানদের নিয়ে মাঠে এসেছেন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় সাকরাইন উৎসবে আমিও ঘুড়ি ওড়াতাম। ঘুড়ি কাটাকাটিতে সবচেয়ে মজা। এখন কাজের চাপে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ছেলে-মেয়েদের আবদারে ওদের এখানে নিয়ে আসা। আগে শুধু ঘুড়িই উড়াইতাম আমরা। এখন ঘুড়ি ওড়ানো কমে গেছে।
পুরান বিভিন্ন গলির দোকানগুলোতে ঘুড়ি পাওয়া গেলেও ঘুড়ির সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় শাঁখারিবাজারে। সোমবার-মঙ্গলবার শাঁখারিবাজারে দেখা যায়, নানা দোকানে সাজানো রয়েছে রং-বেরংয়ের ঘুড়ি, লাটাইসহ বিভিন্ন দামের সুতা। চারবুয়া বা কাউটা, টানা চোখ, গোল চোখ, মৌসুমি, লাভ, লাইলাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি রয়েছে। ৫ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এই ঘুড়িগুলো। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সুতা ও লাটাই রয়েছে। আকৃতিভেদে লাটাইয়ের দামেও রয়েছে ভিন্নতা। সর্বনি¤œ ১০০ থেকে ৮০০ টাকার দামেও বিক্রি হচ্ছে। মোটা-চিকনভেদে বিক্রি হচ্ছে নানা রংয়ের সুতা। সর্বনিম্ন ৭০ থেকে ১০০০ টাকা দামের সুতাও এসেছে বলেন বিক্রেতারা। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি কম বলে জানান তিনি।
পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারের ঘুড়ি ব্যবসায়ী রমাকান্ত হালদার বলেন, এবার ঘুড়ি বিক্রি হয়েছে কিন্তু কম। মানুষ এখন ঘুড়ির থেকে গান বাজনায় বেশি মাতে। ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব হয়ে গেছে গান বাজনা আর ডিজে পার্টির। ছেলে মেয়েরা সাকরাইন উৎসবটাই জানে না। স্থানীয়রাই এই ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব ধরে রেখেছে। এবার সব মিলিয়ে ২ হাজার ঘুড়ি বিক্রি হয়েছে। গতকাল ১৪ হাজার বিক্রি করেছি।
শাঁখারি বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা বিরেন বোস জানান, ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় আমরা আগের মতো সময় দিতে পারি না। তবে ছেলে মেয়েদের চাপে বাসার ছাদে সাউন্ড সিস্টেম এনেছি। যদিও আমাদের সময় হাজার হাজার ঘুড়ি ওড়ানো হতো। তখন মানুষ সাকরাইনটা সবচেয়ে বেশি আমেজ নিয়ে উদযাপন করত। এখনকার ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ানোর চেয়ে আতশবাজি ফুটানো ও ডিজে গানে বেশি আগ্রহী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার ফজলুল হক বলেন, সাকরাইন ঘিরে মানুষের জনজীবনে যাতে সমস্যা সৃষ্টি না হয়, এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল। আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।