ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

পৌষ সংক্রান্তিতে মাছের মেলা 

দুইশ’ বছরের প্রাচীন  কয়েক কোটি টাকার কেনাবেচা

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন ও মামুন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

দুইশ’ বছরের প্রাচীন  কয়েক কোটি টাকার কেনাবেচা

.

প্রতি বছরের মতো এবারও প্রায় দুইশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ৩ দিনব্যাপী মাছের মেলা মঙ্গলবার শেষ হয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা বসে। অধীর অপেক্ষায় থাকেন বছর ঘুরে কখন এ মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হবে।  প্রায় দুইশ’ বছরের অধিক সময় থেকে চলে আসা মেলায় হাওড় ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা। মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে শেরপুর এলাকায় বসে প্রতি বছর ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। আর এ অঞ্চলের মানুষ অধীর আগ্রহে থাকেন কখন বছর ঘুরে শুরু হবে মাছের মেলা। এ বছর মেলায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা মূলের বাঘাইড় মাছ উঠেছে। হাওড় ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছ সাধারণত নিয়ে আসেন এই মেলায়। পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওড়, কাওয়াদিঘি হাওড়, হাইল হাওড় ও সুনামগঞ্জের টাঙুগুয়ার হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা দেশীয় প্রজাতির রুই, কাতলা, বোয়াল, বাঘাইড় ও আইড় মাছসহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন মেলায়।
কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি। বাঙালিরা পৃথিবীর সব নামিদামি খাবার খেলেও তাতে যেন তৃপ্তি মেটে না। অন্য খাবার যাই খায় না কেন ভোজনপ্রেমীদের একবেলা ভাতের সঙ্গে মাছ খেতেই হবে। এই মাছ একটি শীতল রক্তবিশিষ্ট মেরুদ-ী প্রাণী। মাছ মানবদেহে অন্যতম আমিষ জোগানদাতা। মাছ জলে চলাচলের জন্য পাখনা রয়েছে। এদের দেহে সচরাচর আঁইশ থাকে। সাধারণত এরা জলকেই বসবাসের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।  
বেশিরভাগ মাছের দেহে আঁইশ রয়েছে। সাধারণত এদের দেহের বহির্ভাগ আঁশ দ্বারা আচ্ছাদিত। তবে আঁশ নেই এমন মাছের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। মাছ পাহাড়ি ঝরনা থেকে সমুদ্রের লোনা পানি এবং মিঠা পানির খাল, বিল, হাওড়, বাঁওড়, নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবায় বাস করে। 
মৌলভীবাজার জেলার শেরপুরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে বিশাল মাছের মেলা বসে। কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রায় দুইশ’ বছর পূর্ব থেকে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী মিঠা পানির মাছের মেলা আজ পর্যন্ত স্বগৌরবে চলছে। মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে শেরপুর এলাকায় প্রতি বছর এ মাছের মেলা হয়। আর এ অঞ্চলের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন কখন বছর ঘুরে আসবে এই দিনটি আর শুরু হবে মাছের মেলা। মেলার দিন মৌলভীবাজার-সিলেট ও সিলেট-ঢাকা সড়কে মেলামুখী মানুষের স্রোত। কুশিয়ারা নদীর তীরজুড়ে ছোট বড় তিনশ’ মাছের দোকান। এই আয়োজনই জানান দেয় মেলা উপলক্ষে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার। এটি সিলেট বিভাগের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। মেলায় উঠেছে নানা জাতের বিশাল মাছ। এমন অদেখা বড় মাছ দেখতে আর কিনতে দর্শক ক্রেতার কমতি নেই। দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছের এমন সমারোহে যেন ফিরে এসেছে মিঠা পানির মাছের সেই হারানো সোনালি অতীত। মেলায় এক সঙ্গে বড় আকারের এত মাছ দেখে আগন্তুকরা আশ্চর্য হচ্ছেন। তাই বাড়তি কৌতূহল নিবারণে তারা পুরো মাছের মেলা ঘুরে দেখছেন। আবার কম বয়সের আগন্তুকরা মুঠোফোনের ক্যামেরায় এবং ক্যামেরার মাধ্যমে নানা দৃশ্য ধরে রাখছেন। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাছের মেলাটি শুরু হলে এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। 
আগে এই মেলা একদিনের জন্য হলেও গত কয়েক বছর ধরে ৩ দিনব্যাপী মেলায় হাওড় ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা ও পাইকাররা ভিড় জমান। মেলা উপলক্ষে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দূর-দূরান্তের মানুষ আসেন মাছ কিনতে। মেলা উপলেক্ষে এ এলাকার প্রতিটি বাড়িতে বড় বড় মাছ ও নতুন সবজি কিনে স্বজনদের আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়। মেলায় ৭৫ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ আড়াই লাখ টাকা দাম চাওয়া হয়। মৌলভীবাজার শহরের প্রবাসী ক্রেতা ফজলুর রহমান দাম বলেন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
মেলায় পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওড়, কাওয়াদিঘি হাওড়, হাইল হাওড় ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, গজার, বাঘাইড় ও আইড়সহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন মোলায়। মেলায় ৭৫ কেজি ওজনের বাঘাইড়, ৩০ কেজি ওজনের বোয়াল, ২০ কেজি ওজনের ব্ল্যাক কার্প, ১৫ কেজি ওজনের রুই, ১৮ কেজি ওজনের কাতলসহ বড় বড় ব্রিগেড, সিলভার, গ্রাসকার্প, সোনালি রঙের ১১ কেজি ওজনের কার্প মাছ, ২০ কেজি ওজনের দেশী কার্পসহ দেশীয় চিংড়ি, পাবদা, গোলশা, ফালি, কাকিয়াসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয় এ মেলায়। 
তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম অনেকটায় বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। মেলায় বিশালাকৃতির বাঘাইড়, রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, আইর, চিতল ও মাছগুলো প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ২৫০০ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। 
আয়োজকরা বলেন, যদিও এটি মাছের মেলা নামে পরিচিত তথাপি মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালী সামগ্রী, খেলনাসহ গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই মাছের মেলা মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। 
মেলার মাছের ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ মিঠাপানির বড় আকারে বাঘাইড় মাছ। এ বাঘাইড় মাছ একটা সময় দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়ে সহজলভ্য ছিল। প্রায়ই জেলেদের জালে ধরা পড়ত বড় বড় বাঘাইড়। সাধারণ মানুষের কাছেও অতি পরিচিত এ মাছ। অপরিকল্পিতভাবে ও নির্বিচার নিধন এবং নদ-নদী ভরাটসহ নানা কারণে এই মাছ বিলুপ্তির পথে। সম্প্রতি বন্যপ্রাণী আইনে বাঘাইড় মাছকে সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং মাছ ধরা ও ক্রয়-বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়।
বিপন্ন বাঘাইড় মাছ রক্ষায় মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। কিন্তু বাঘাইড় মাছ ধরা ও বিক্রি বন্ধ হয়নি। 
হবিগঞ্জের প্রাণের উৎসব ॥ মঙ্গলবার শুরু হয়েছে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পইলের মাছের মেলা। এ মেলায় হাওড় এলাকার দেশীয় মাছ পাওয়া যায়। এখানে বোয়াল, আইড়, পাবদা, রুই, কাতল, চিতল, কালীবাউস, টাকি, পুঁটি, মাগুরসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। সদর উপজেলার পইল গ্রামের ঈদগাহের কাছে বসে দেশীয় মাছের এ মেলা। মেলার বেশিরভাগ মাছ হাওড় ও বিল থেকে সংগ্রহ করা। এই মেলা উৎসবে রূপ নেয়। হবিগঞ্জ ছাড়াও মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, এমনকি ঢাকা থেকেও এখানে লোকের সমাগম হয়। 
মেলায় আলাপকালে বিক্রেতা ফজল মিয়া বলেন, এবার বড় আকারের দুটি বোয়াল মাছ নিয়ে এসেছেন। এগুলোর দাম হেঁকেছেন ৭০ হাজার টাকা। মুদ্দত আলী ও ইমরান মিয়া নামে দুই বিক্রেতা জানান, হাওড় থেকে জীবিত বোয়াল ও আইড় মাছ এনেছেন। বিক্রির জন্য বসে আছেন। ক্রেতারা এসে দাম করছেন। বিক্রেতা সাজু মিয়া বলেন, একটি রুই মাছ নিয়ে এসে ৩৫ হাজার টাকা দাম চেয়েছেন। তিনি জীবিত আইড় মাছও নিয়ে এসে দাম চাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা। এমনভাবে দুই শতাধিক বিক্রেতা মাছ নিয়ে বসেন।
ক্রেতা বাচ্চু মিয়া, কাজল মিয়া, আবুল হোসেন বলেন, মেলায় প্রচুর মাছ এসেছে। আমরা মাছ ক্রয় করেছি। মাছগুলো দেশীয় নানা প্রজাতির। আমাদের মতো শত শত ক্রেতা মাছ ক্রয় করেন। যুগের পর যুগ এ মেলা ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মাছের মেলা উপলক্ষে কৃষিজাত পণ্য, শিশু-কিশোরদের খেলনা, দেশীয় ফার্নিচার, তৈজসপত্র, সবজি ও ফল, শীতকালীন পোশাক, মিষ্টান্নসহ কয়েকশ’ স্টল নিয়ে মেলা জমে ওঠে।

 

×