.
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা নাটকের নতুন আলোর দিশারী সেলিম আল দীন। পশ্চিমা নাট্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেছেন হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্যে। বাংলা নাটকে প্রবর্তন করেছেন বর্ণনাত্মক ধারা। নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। আজ মঙ্গলবার দেশের নাট্য আন্দোলনে পথিকৃৎ নাট্যকার সেলিম আল দীনের ১৭তম প্রয়াণবার্র্ষিকী। ২০০৮ সালের এই দিনে (১৪ জানুয়ারি) তিনি অদেখার ভুবনে পাড়ি জমান।
কিংবদন্তি এই নাট্যকারের প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে নাট্যদল স্বপ্নদল তিন দিনব্যাপী নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্মরণোৎসবের আয়োজন করেছে। দুই ধাপে অনুষ্ঠিতব্য কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যাচার্যের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বের করা হবে স্মরণ শোভাযাত্রা। ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে স্বপ্নদলের প্রশংসিত প্রযোজনা ‘চিত্রাঙ্গদা’। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে উৎসর্গ করে নির্মিতবাঙলা মূকাভিনয়রীতির দর্শকনন্দিত মূকনাট্য
‘ম্যাকবেথ’-এর দু’টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ জানুয়ারি একই ভেন্যুতে বিকেল পাঁচটা ও সন্ধ্যা সাতটায় মঞ্চস্থ হবে মূকনাট্য ‘ম্যাকবেথ’।
বাংলা মঞ্চ নাটক আর সেলিম আল দীন-কথা দুটি প্রায় সমার্থক। নাট্যরচয়িতা হিসেবেই শুধু নন, দীর্ঘ তিন যুগ ধরে নাট্যকেন্দ্রিক নানা কর্মতৎপরতা, গবেষণা, চর্চা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সেলিম আল দীন নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। সেখানে রবীন্দ্র উত্তরকালে আর কেউ পৌঁছতে পারেননি। তারই আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। ১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম তিনি। নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটারও। সারাদেশে আয়োজন করেছেন নানা নাট্যমেলা, উৎসব, পার্বণের। সব মিলিয়ে বাংলা নাটকে তার তুলনা তিনি নিজেই।
বাংলা নাটকের একটি নতুন বাঁকের স্রষ্টাও সেলিম আল দীন। একটি ধারা একক প্রচেষ্টায় সৃষ্টি করেন তিনি। বাংলা নাটকের গবেষণাতেও তার অবদান আজ প্রতিষ্ঠিত। বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতিকে অতীতের সিন্দুক থেকে তুলে এনেছেন বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার বাংলাঘরে। তিনি দেখিয়েছেন বাংলা নাট্যরীতি একেবারেই নিজস্ব। এই নাট্যরীতি ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো পাশ্চাত্যের প্রেরণাতাড়িত বিষয় নয়। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প উদ্দীপনাগুলো নিজের সৃষ্টিকর্মে প্রয়োগ করেছেন তিনি।
সেলিম আল দীন উপাখ্যান বা আখ্যান রচনা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য ধারার নাটকের মতো ‘অংক’, ‘দৃশ্য’ এসব না এনে আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থেকে উপাখ্যান রচনার এক আধুনিক নিজস্ব রীতি তৈরি করেছেন। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যের একটি বিশেষ গুণ হলো এর বর্ণনা রীতি। লেখক সেই বর্ণনা রীতিকে ব্যবহার করেছেন। বর্ণনা রীতির এই ব্যবহার তার সব রচনাতেই তিনি ব্যবহার করেছেন। ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘প্রাচ্য’, ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ ইত্যাদি মাস্টারপিস আখ্যান নির্মাণ করে তিনি বাংলা নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। নাট্যাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, নান্দিকার পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।