ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১ মাঘ ১৪৩১

শিকড়ে ফেরার পৌষসংক্রান্তি

আবহমান ঐতিহ্যের গৌরব, লোক আচার

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

আবহমান ঐতিহ্যের গৌরব, লোক আচার

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পৌষ সংক্রান্তিতে, পিঠা-পুলির আয়োজন থাকবে ঘরে ঘরে

শীত অনুভূত হচ্ছে কি? কতটা? অনুভূত হোক বা না হোক, প্রিয় ঋতুর প্রথম মাসটি কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। আজ মঙ্গলবার ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। মানে, পৌষের শেষ দিন। শুরুর দিনটি যেমন তেমন, বিদায়ের দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ পৌষের শেষ দিন মানেই পৌষসংক্রান্তি। চিরায়ত ঐতিহ্য মেনে বাঙালি আজ পৌষ মাসকে বিদায় জানাবে। আবহমান কাল ধরে চলা আচার অনুষ্ঠান পালন করা হবে। গ্রামীণ জনপদে আয়োজন করা হবে পৌষমেলার। বিভিন্ন বাসা বাড়িতে থাকবে পিঠা-পুলি-পায়েসের আয়োজন। একইদিন নাগরিক উৎসব উদ্যাপনের অংশ হিসেবে রাজধানীর পুরান ঢাকা মুখরিত হবে সাকরাইন উৎসবে।
পৌষসংক্রান্তিকে পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। লোক গবেষকদের মতে, এটি মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। মকরসংক্রান্তি বলতে, নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের ক্ষণটিকে ইঙ্গিত করে। মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন তিল কিংবা খেজুরগুড় দিয়ে তিলুয়া তৈরি করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল একসময়। নতুন চালে তৈরি করা হতো পিঠা। এ কারণে পৌষসংক্রান্তির আরেক নাম তিলুয়া সংক্রান্তির বা পিঠা সংক্রান্তি। এদিন শিশু-কিশোররা বাস্তুর গান, কুলাইর ছড়া, হোলবোলের গান, বাঘাইর বয়াত গেয়ে চাল ও অর্থ সংগ্রহ করে পৌষপালা, বনভোজন ইত্যাদির আয়োজন করত। একই দিন দধি সংক্রান্তির ব্রত শুরু করা হতো।
অবশ্য আগের মতো বিচিত্র উদ্যাপন এখন চোখে পড়ে না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিভিন্ন আচার পালন করতে দেখা যায়। এর বাইরে প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে উৎসবে কিছু যোগ করছেন। কিছু বিয়োগ হচ্ছে। তবে পৌষসংক্রান্তি উদ্যাপন থেমে নেই। অনেকে আবার পৌষের শেষদিনটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান না। তার আগে থেকেই উদ্যাপন শুরু করে দেন। পিঠা-পুলি পৌষসংক্রান্তি উৎসবের সবচেয়ে প্রিয় অনুষঙ্গ। এ সময় গ্রামের বিভিন্ন ঘরে তৈরি হয় ভাপা, পাটিশাপটা, সন্দেশ, দুধ চিতই, মুগ পুলিসহ নানা রকম পিঠা। মায়েরা, মেয়েরা রাত জেগে পিঠার গায়ে অলঙ্করণ করেন। ফুল লতাপাতা, পাখি, মাছের চোখ আঁকেন। এভাবে গোটা রাত পার হয়ে যায়। একদিকে চুলো থেকে পিঠা ওঠে। অন্যদিকে চলে গরম গরম খাওয়া। মায়ের হাতে তৈরি পিঠার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ করে দেয় পৌষসংক্রান্তি। আত্মীয়-স্বজনদেরও এ সময় পিঠা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানো হয়।
পৌষসংক্রান্তিতে বসে পৌষমেলাও। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা আয়োজন করতেন। এখনো পৌষমেলায় লোকজ সংস্কৃতির নানা পণ্য দিয়ে স্টল সাজান দোকানিরা। রাখা হয় পিঠা পায়েস খেজুরের রস- আরও কত কী! রাজধানীতেও বড়সড় পৌষমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। মেলায় যথারীতি থাকে পিঠা-পুলি। বেশ কিছু স্টলে পিঠা তৈরি করতে দেখা যায়। সকলের চোখের সামনেই পিঠা তৈরি হয়। চাইলে কিনে খাওয়া যায়। একই সময় লোকজ আয়োজন থাকে অনুষ্ঠান মঞ্চে। মঞ্চ থেকে জারি, সারি, ভাটিয়ালি গানে লোকায়ত সংস্কৃতির জয়গান করা হয়। পুঁথি পাঠ, নৃত্য, নাটকের ভাষায় শহুরে প্রজন্মকে আহ্বান জানানো হয় মাটির কাছাকাছি আসার। তবে এবার দেশজুড়ে অস্থিরতা। নানা টানাপোড়েন চলছে। এই বাস্তবতায় ঢাকার পৌষমেলাটি আয়োজন করা হবে না বলেই জানা গেছে। যে সংস্কৃতিকর্মীরা আয়োজন করতেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভরসা পাচ্ছেন না তারা।  
একই কারণে পৌষসংক্রান্তির দিন লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে যে পৌষসংক্রান্তি উৎসবের আয়োজন করা হতো, এবার সেটি হবে না। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তার সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা অনেক বছর ধরে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তবে এবারের আয়োজনটি, যতদূর জানা গেছে স্থগিত করা হয়েছে।  
এদিকে পৌষসংক্রান্তির-ই আরেক রূপ দেখা যাবে আজ পুরান ঢাকায়। সেখানে ব্যাপকভাবে উদ্যাপন করা হবে সাকরাইন উৎসব। একে নাগরিক উৎসব মনে হলেও, এর সঙ্গে লোক ঐতিহ্য ও উদ্যাপনের যোগ আছে। উৎসবটির মূল আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো। পুরান ঢাকার আকাশ আজ রং বেরঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যাবে। সকাল সকাল বাসা বাড়ির ছাদে অবস্থান নেবেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সেখান থেকে ঘুড়ি ওড়াবেন তারা। চলবে কাটাকাটি খেলাও।   
কবে থেকে ঢাকায় এই ঘুড়ি ওড়ানো শুরু? কারা শুরু করেছিলেন? জানতে কথা হয় ঢাকা গবেষক হাশেম সূফীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পৌষসংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর ঐতিহ্য অনেক পুরনো। বহুকাল আগে পাঠানদের হাত ধরে ঘুড়ি এসেছিল ঢাকায়। পরে ঘুড়ি ওড়ায় মোগলরাও। সে সময় নানা কারণেই ঘুড়ি ওড়ানো হতো। এখন সাকরাইন উৎসবে ব্যাপকভাবে ঘুড়ি ওড়ানো হয় বলে জানান তিনি।
একই নিয়মে আজ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসার ছাদে, খোলা মাঠে অবস্থান নিয়ে চলবে ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা। রাতে থাকবে আতশবাজির আয়োজন। পিঠা-পুলি সুস্বাদু খাবার সংগীত নৃত্যায়োজন কিছুই বাদ যাবে না। পুরান ঢাকার মতো নতুন ঢাকায়ও প্রিয় হয়ে উঠছে পৌষসংক্রান্তি। এ অংশেও আজ কম বেশি ঘুড়ি ওড়ানো হবে। চলবে পিঠা-পুলির আয়োজনও। এভাবে শেকড়ে ফেরার সুযোগ করে দেবে আবহমান ঐতিহ্যের পৌষসংক্রান্তি।

×