ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

বিরল হিমালয় অভিযান শীতকালে

ল্যাংটংয়ের তিন শিখরে পাঁচ নারীর পায়ের ছাপ

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০১:১৪, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

ল্যাংটংয়ের তিন শিখরে পাঁচ নারীর পায়ের ছাপ

তীব্র শীতের মধ্যে দুর্গম হিমালয় অভিযান সম্পন্ন করে নতুন কীর্তি গড়েছেন বাংলাদেশের নারীরা

গত কদিন নেপাল ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল আমার। দেশটির শীত সম্পর্কে তখন বাস্তব একটি ধারণা হয়েছিল। পাহাড়বেষ্টিত নাগরকোটের শীত আগুন ছাড়া কোনো কিছুকেই পাত্তা দেয়নি। এই বাস্তবতায় হিমালয় পর্বতের ঠান্ডা কেমন হতে পারেÑ দূর থেকে তা কল্পনা করতেও ভয় হচ্ছিল। অথচ কী কা-! ওই প্রতিকূল সময়েই হিমালয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন পাঁচ বাংলাদেশী এবং তাদের সবাই ছিলেন নারী!

সাধারণ সময়েই হিমালয় অভিযান যারপরনাই ঝুঁকিপূর্ণ। তীব্র শীতে চ্যালেঞ্জটি আরও বড় হয়ে যায়। অভিযাত্রী দল তবু শীতের মধ্যেই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিল। বলা বাহুল্য, তাদের সাহসী এবং বিরল অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে! ল্যাংটাং হিমালয়ের তিনটি চূড়া জয় করেছেন তারা। বাংলাদেশী পাঁচ নারীর পায়ের ছাপ পড়েছে সেখানে।

অভাবনীয় অনুকরণীয় সাফল্য বয়ে আনা নারীদের মধ্যে রয়েছেন এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার। তার নেতৃত্বে অভিযানে আরও অংশ নেন ইয়াসমিন লিসা, তহুরা সুলতানা রেখা, প্রশিক্ষণার্থী ট্রেকার এপি তালুকদার এবং অর্পিতা দেবনাথ। 
আরেকটি নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি বেগম রোকেয়া। সব সময়ের মতো এই পর্বতারোহণের ক্ষেত্রেও নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছিলেন তিনি। গত বছরের মে মাসে ইউনেস্কোর ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিজিওনাল রেজিস্টার ফর এশিয়া প্যাসিফিক’ তালিকায় স্থান করে নেয় মহীয়সী নারীর লেখা ‘সুলতানাজ ড্রিম’। নারী মুক্তিকে বড় করে দেখা এই সাহিত্যকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘সুলতানাজ ড্রিম আনবাউন্ড’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’ স্লোগানে পরিচালনা করা হয় এবারের জটিল হিমালয় অভিযান। 
নেপালে অবস্থানকালে নিশাত মজুমদারের সঙ্গে আমি হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, অভিযান শুরু করে দিয়েছেন তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ করা গেলে ১২ জানুয়ারি নাগাদ কাঠমান্ডুতে ফিরতে পারবেন। তখন তাদের সঙ্গে দেখা করা যাবে বলেও জানিয়েছিলেন নিশাত। তার আগেই আমি নেপাল ত্যাগ করায় দলটির সদস্যদের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি।

তবে অভিযানের উদ্যোক্তা পর্বতারোহীদের সংগঠন ‘অভিযাত্রী’ নিয়মিতভাবে তথ্য দিচ্ছে। তাদের গত শুক্রবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫ হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ইয়ালা পিক, ৫ হাজার ১৪৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন সুরিয়া পিক এবং ৪ হাজার ৭৪৭ মিটার উঁচু গাঁসাইকুন্ড পিক জয় করেছেন বীর নারীরা। প্রতিটি চূড়ায় দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন তারা।   
অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৮ ডিসেম্বর ছিল দলটির রিকভারি ডে। ওই দিন হাইকিংয়ে ৪ হাজার মিটার উচ্চতাসম্পন্ন লিরুং লেকে যান সবাই। শীতের কারণে লিরুং লেকের পানি জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। বিকেলের দিকে আবার তীব্র তুষারপাত শুরু হয়। এ অবস্থায় পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর ইয়ালা পর্বতের বেসক্যাম্পে (৪৮৪০ মিটার) পৌঁছে অভিযাত্রী দল।

তিন পর্বতারোহী সামিট পুশের উদ্দেশে রয়ে যান সেখানে। বাকি দুইজন নবীন ট্রেকার বেসক্যাম্প থেকে ফিরে যায় কেয়াঞ্জিং গ্রামে। ৩০ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় নিশাত মজুমদার ইয়াছমিন লিসা ও তাহুরা সুলতানা রেখাকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ালা পর্বতের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। এটি ছিল টিম সুলতানাজ ড্রিমের প্রথম সফল আরোহণ। 
দ্বিতীয় অভিযানে নেমে ব্যাডেন পাওয়েল বেইস ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে হয় অভিযাত্রীদের। ২ জানুয়ারি টিম যায় বেইস ক্যাম্পে। ভাবনায় তখন ছিল বেইস ক্যাম্প হবে ৫ হাজার মিটার উচ্চতায়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, ৪ হাজার ৮০০ মিটার থেকে হার্ড আইস শুরু হয়ে গেছে। ফলে বেইস ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ৪ হাজার ৭১৭ মিটার উচ্চতায়। টিমের গাইড ভোর ছয়টায় রুট চালু করতে চলে গিয়েছিলেন।

সন্ধ্যা ৬টায় ফিরে এসে তিনি জানান, তারা খুব কষ্ট করে ৫ হাজার ৪০০ মিটার পর্যন্ত রুট চালু করে রোপ স্থির করতে পেরেছেন। অনেকগুলো ক্রিভাসও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এগুলো অতিক্রম করার মতো সরঞ্জাম টিমের কাছে ছিল না। তাই ওই মুহূর্তে আর সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, নয়া কাংগা আর ব্যাডেন পাওয়েল একটাই উচ্চতার। ব্যাডেন পাওয়েলের তুষার এবং বরফের যে অবস্থা নয়া কাংগার একই অবস্থা ছিল। এই দুটি পিক আরোহণ করার জন্য আরও সময় এবং সরঞ্জামের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। তাই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়।

টিম ক্যাঞ্জিন থেকে চলে যায় গোঁসাইকুন্ড। নবীন দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে গোঁসাইকুন্ড পিকে আরোহণ করে অভিযাত্রী দল। আরোহন করে সুরিয়া পিকেও। সমস্ত অভিযান সফলভাবে শেষ করে টিম নিরাপদে ধুঞ্চে পৌঁছে বলেও জানান সংগঠকরা। 
সফল অভিযানের পর নিশাত মজুমদারের ভাষ্য : বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল, বাংলার নারীরা একদিন সত্যিকার অর্থেই জেগে উঠবে। মেধায় এগিয়ে যাবে নারী। নেতৃত্ব দেবে দুঃসাহসিক সব কাজে। নারী হয়ে উঠবে সাফল্যের দীপ্ত প্রতীক। রোকেয়ার মহাপ্রস্থানের ১০০ বছর পর তাঁর স্বপ্ন সত্যি হতে দেখছি আমরা। বর্তমানে সমাজের সর্বত্রই নারী তার সাফল্যের চিহ্ন রাখছে।

এরই ধারাবাহিকতায় দুর্গম হিমালয় অভিযান সম্পন্ন হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী দুই একদিনের মধ্যে পুরো দল দেশে ফিরবে বলে জানিয়েছেন নিশাত মজুমদার।

×