সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া চলমান সময়ের ন্যায্যতা। সমসংখ্যক নারী যদি উন্নয়নের অবধারিত অগ্রযাত্রায় শামিল হতে পিছু হটতে হয় তা হলে সার্বিক প্রবৃদ্ধি অধরা থাকাই বাঞ্ছনীয় হতে সময় নেবে না। শুধু কি উন্নয়ন? আরও বেশি করে বলা যায় বৈচিত্র্যময় পোশাকে আয়ত্বে আনতে নারীদের পিছু হটা সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। কিন্তু গতি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়া পরিস্থিতির এক প্রকার প্রদাহ। যেমন নারী শিক্ষার হার বাড়ছে গত শতাব্দীর মধ্যগগন থেকে। কিন্তু পেশা নির্বাচনে ছিল কিছুটা স্থবিরতা। প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হয়েছে শিক্ষকতা। আজও তেমন পেমা মর্যাদা আর সামাজিক পরিবেশের অনন্য চাহিদা। কিন্তু সময়ের গতিতে নিত্য নতুন পেশায় সংযুক্ত হওয়াও বিশেষ পারদর্শিতা। যেখানে ভিন্ন ধর্মী স্পর্শকতার পেশা সাংবাদিকতার ভুবনে আগমন গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই। সমসংখ্যক নারী কিন্তু বিভিনস্ন পেশাকে অবলীলায় সম্পৃক্ত করতে হোঁচট খাওয়াও এক অবধারিত পর্যায়। আজও তেমন নারী খুঁজে পাওয়া যাবে। যদিও সংখ্যায় তারা নিতান্ত কম। আজ তেমনই এক গণমাধ্যম কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে কত বাধাবিঘ্ন কিংবা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে এগিয়ে চলা থেকে পেশা নির্বাচনেও।
ফারজানা নীলা একজন সংবাদমাধ্যমের কর্মকর্তার কাতারে প্রবেশের যে প্রতিবন্ধকতার আবর্তে পড়েছেন সেটাও এক নির্মমতা। বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠক কিংবা আলাপচারিতায় উঠে আসে কোনো কন্যা শিশু প্রথমেই বৈষম্যের শিকার হয় পারিবারিক আবহ থেকেই। বিশেষ করে জন্মদাত্রী মাই তার পুত্রের সঙ্গে অবোধ মেয়েটির পার্থক্য তৈরি করতে এগিয়েই থাকেন। এমনকি জন্ম থেকেই। জন্মই যেন আমার আজন্মের পাপ। মায়ের ইচ্ছা পুত্র সন্তান। জন্মালো কন্যা, মানতে কষ্ট হয় পুরো পরিবারেরই। ফারজানা নীলাও তেমন বৈষম্য আর চাপের মধ্যে বড় হয়েছেন কন্যা হওয়ার মহা অপরাধে। শিক্ষা শহর রাজশাহীর নাটোরে জন্ম নেওয়া নীলা তেমন অসাম্যের গল্প বলতে গিয়ে অনেকটাই হতভম্ব, দিশাহারা। তেমন বেদনাদায়ক জীবন কাহিনী শুনতে প্রতিবেদকও কেমন যেন চিন্তিত, মর্মাহত।
পিতা মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন। মাতা আমেদজান বেগম। দুঃখজনক হলেও এই দম্পতির দুই সন্তানই কন্যা। ২ বোনের সংসারে তারা কখনো সন্তানের মর্যাদা পাননি বাবা-মায়ের স্নেহ আদরে। বরং নিগৃহীত হতে হয়েছে কন্যা হিসেবে। কিন্তু লড়াকু ও আত্মপ্রত্যয়ী দুই কন্যাই পারিবারিক লাঞ্ছনা গঞ্জনাতেও দমে যাবার পাত্রী নন। লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যে সংগ্রামকে আলিঙ্গন করতে হয় সেটাকেও ডিঙিয়ে তৈরি হয়েছেন নির্দ্বিধায়, অবলীলায়। রাজশাহীর পিএন গার্লস হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক করেন দুই বোনই। রাজশাহী মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়। উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠে পৌঁছানো কত যে বিঘ্নতার আবর্ত তাও তোয়াক্কা করেননি তারা। সম্মান, স্নাতক করার সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় নীলাকে। এক সময় বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। দাম্পত্য জীবন শুরু করা আগের অবস্থার পটপবির্তন। পাবনার সন্তান স্বামী হাসিবুল ইসলাম। শুধু তাই নয় ঢাকায় ‘যায়যায় দিন’ সাময়িকীর সহ-সম্পাদক। শ^শুর পাবনার গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষক। এতিম ও বিচ্ছিন্ন পিতা-মাতার শিশুদের নিয়ে চিলরেন্ড-ভিলেজ কাজ করেছেন নালা। সেখান থেকে পরবর্তীতে গণমাধ্যম কর্মী হওয়া জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত চাওয়া। যা আজ তাকে মুগ্ধতার স্রোতে ভাসিয়ে নিচ্ছে। দুই কন্যা সন্তানের জননী নীলা কিন্তু কন্যাকে বড় করছেন মানুষের মর্যাদায়, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। কোনো বৈষম্যের আঁচড় লাগতে দিচ্ছেন না শিশু কন্যা দুটির ওপর। যা তাকে ভুগিয়েছে জীবনভর। পিতা-মাতা শুধু যে অনাদরে, অবহেলায়, চরম বিরক্তিতে বড় করেছেন তা কিন্তু নয়। বরং তাদের সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করাও কন্যা নিগ্রহের চরম বিপত্তি। মা পর্যন্ত তা পিতৃদত্ত সম্পত্তি দুই কন্যাকে দেননি। বরং তার মামাত ভাইদের দিয়ে দিতে কসুর করেননি। সত্যিই এক ব্যতিক্রমী বিরল ঘটনা। যা বাংলাদেশের গ্রামে, শহরে, বিভিন্ন প্রত্যন্ত জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সামনে আসতেও বাধা বিপত্তির কোপানলে পড়তে হচ্ছে। তবে স্বামী কোনো বৈষম্যকে মানেন না। তার মর্যাদা দিতেও কসুর করেননি। সঙ্গতকারণে নারীদের জন্য ব্যতিক্রমী পেশা গণমাধ্যম কর্মকর্তার আসন অলঙ্কৃত করে যাচ্ছেন। এখন ভিউজ বাংলাদেশে সাংবাদিক হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। দুই কন্যা গুলবদন আর মাহিমাকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর বিপত্তির কোনো ছায়া কন্যাদের ওপর পড়তে না দেওয়ার প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা অন্তরের নিভৃতে জিইয়ে আছে। নিজের অসাধারণ জগৎ সাংবাদিকতার ভুবনেও প্রয়োজনীয় ভূমিকা দায়িত্ব পালনে মোটেই দমে যাচ্ছেন না।
পরিবার যখন কন্যাপ্রধান
শীর্ষ সংবাদ: