বাংলাদেশ শস্য শ্যামল প্রান্তরের এক অনন্য বরেন্দ্র অঞ্চল। সমুদ্র পরিবেষ্টিত আর নদ-নদী বিধৌত আবহমান বাংলা বুনন আর কারুশিল্পেও কতখানি সমৃদ্ধ সেটাও এই সবুজ ঘেরা ব-দ্বীপের চিরস্থায়ী ঐতিহ্যিক সম্ভার। যা কি না আধুনিক প্রযুক্তির নির্মাল্যে ও স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। শুধু কি তাই? গ্রামীণ ঐতিহ্যিক বহু সম্ভারের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে আছে সমসংখ্যক নারীর কৃষ্টি, সংস্কৃতিই শুধু নয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যেরও অপার সম্ভাবনার নিজস্ব ভুবন। সেখানে শীতের আমেজসহ ঠান্ডার যে চমৎকার পরশ আর পরিবেশ তাতে কিছু ঐতিহ্যিক বৈশিষ্ট্য আজও নারী সমাজকে নতুন প্রেরণা আর শক্তিতে উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। যেখানে সৃষ্টির মহিমান্বিত রূপ শৌর্যও নয়নাভিরাম, উপাদেয় এবং পরম স্বস্তিকর। সময়ের গতিতে লাগাতার নকশা, কারু ও বুনন শিল্পের চাহিদা কমে না যাওয়া আরও এক প্রাপ্তি এবং ন্যায্যতা। আমরা এই মুহূর্তে অতিক্রম করছি পৌষ মাসের কনকনে ঠান্ডার শীতল পরশের অনন্য সন্ধিক্ষণ। ঋতু বৈচিত্র্যের নানামাত্রিক আমেজ যে মাত্রায় আবহমান বাংলা ও বাঙালিকে নাড়িয়ে দেয় সেখানে পরিবেশ পরিস্থিতিও এক অনন্য নৈসর্গিক আবেদন।
কবি গুরুর ভাষায়-
‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
আয়রে ছুটে আয়
ডালা যে তার ভরেছে আজ
পাকা ফসলে।
সত্যিই নবান্নের পিঠা-পুলির আয়োজন ছাড়াও ফসল ঘরে তোলার সুবর্ণকালে নারীরাও যে কত ব্যস্ত সময় পার করছেন সেটা দৃষ্টিনন্দনভাবে দৃশ্যমান। কৃষিতে নারী যৌক্তিক অভিগমন পুরাকালেরই এক সমতাভিত্তিক শ্রমের অনন্য যোগসাজশ। আমরা সম্পন্ন গৃহস্থের নানি, দাদিদের দেখেছি। কিভাবে ফসলি খেত থেকে ধান সংগ্রহই শুধু নয় প্রয়োজনে সিদ্ধ করা। আবার প্রাসঙ্গিকতায় মাড়াই বিষয়টিও অবিচ্ছিন্ন এক ধান প্রক্রিয়াজাতকরণের সুচারু কর্মবিধি। যদিও প্রযুক্তির সীমানায় কৃষিক্ষেত্রেও যন্ত্রনির্ভরতা আধুনিক সময়ের বরমাল্য। তবুও নারীদের কোমল হাতের পরশ আজও যেন ফসলি সম্ভারকে মায়া মমতায় ঘিরে রেখেছে। ঘরে ফসলি ধান, শাক-সবজি তোলার সুবর্ণ সময়ে গৃহিণী থেকে নারী কৃষি শ্রমিকের ব্যস্ততার যেন শেষ পরিশেষ থাকে না। বাজারে শুধু নতুন ধানের ম-ম গন্ধই নয় বরং শীতের সবজি ভাণ্ডারের যে অভাবনীয় বরণডালা তাও নারী সমাজের অনন্য সমর্পণ আর হাড়ভাঙা শ্রমের নিত্য কর্মযজ্ঞ। যুগ- যুগান্তরের এই সাধন মেলা নতুন সময় আর ভাবনার অনুষঙ্গ হয়ে বৈচিত্র্যিক আবহ তৈরিও অনন্তকালের মহা সম্মিলন।
এ তো গেল ফসলি খেতে নারীর নিরবচ্ছিন্ন কর্মদ্যোতনার নিরন্তর এগিয়ে চলা। তার সঙ্গে নতুন ধানের পিঠা-পুলির আয়োজন সেও এক চিরকালের সমন্বয়ে নবযুগের যথাযথ মেলবন্ধন।
পুরাকাল থেকে আধুনিক প্রযুক্তির সীমানা বিবেচনায়ও নারীদের কর্মদ্যোতনায় নিত্য নতুন উপাদান যুক্ত হলেও আবহমানকালের শাশ্বত বৈশিষ্ট্য ও নব আঙ্গিকে সময়ের জয়গান করে যাচ্ছে। সঙ্গে আলোচনায় আনতে চাই হরেক বুনন শিল্পে নারীদের চিরন্তন সম্ভাবনাময় জগৎ কোন অবস্থানে। এখানে কাঁথা থেকে শুরু করে সোয়েটার, মাফলার বুনা সঙ্গে ভরা সংসারের স্বামী সন্তানের পাঞ্জাবি, কামিজ যার যা প্রয়োজন সেখানে সুঁই সুতায় নিখুঁত কারুকার্য আজও বিলীন না হওয়া আধুনিকতার নব আঙ্গিক তো বটেই। কোন কাঁথা কিংবা সেলাই, ফোড়ে পুরানো কাপড় বিছানোই শুধু নয় সেখান থেকেই সেলাইয়ের জন্য সুতা বের করে গুছিয়ে নেওয়া সত্যিই এক অদ্ভুত ললিতকলার অপার মহিমা। কাঁথার মাস শেষ হয়ে এখন লেপ, কম্বল সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু আর কিছু পরেই আবারও কাঁথা মুড়ে ঘুমানোর সময়টা শুরু হলো বলে। সেই কার্তিক থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত কাঁথাই এই বরেন্দ্র অঞ্চলের ঠান্ডার আবহকে স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয়। তবে আমরা ছোটকালে যে পৌষ মাঘ মাসের তীব্র শীত অনুভব করেছি বর্তমানে সেখানে ভিন্ন প্রতিবেশ সেটা নাকি প্রযুক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে যে শিল্প প্রযুক্তির নব উদ্ভাবন সেটাই উৎপাদনকে অধিকতর গতিশীল করলেও নেতিবাচক প্রভাবে বাতাসে কার্বন নিঃসরণ মানুষের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হয়নি। সেটা বুঝতেও জগৎবাসীকে আরও একটি শতক পার করতে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে নিসর্গ বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুলতে থাকেন ক্রমশ কার্বন নিঃসরণে বাতাস দূষণের আবর্তে পড়ছে। প্রতিক্রিয়ায় ষড়ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সেখানেও নাকি সবার আগে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশু ও সমসংখ্যক নারী। কারণ আবহমান বঙ্গললনারাও চারপাশের আত্মীয়স্বজন থেকে প্রতিবেশ সুরক্ষিত রাখতে নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। এক সময় কুড়ানো খড়কুটো কিংবা গাছের ঝরাপাতা জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়েছে নারী সমাজকে। নিশ্বাসে প্রবেশ সেই চরম বিষাক্ত আগুনের দাবানল।
যাতে অসুস্থ হতেও সময় লাগেনি। আধুনিক প্রযুক্তির বাংলাদেশে তেমন সংখ্যা কমে আসলেও গ্রামীণ নারীরা এখনো সেই দুঃসহ প্রতিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তার ওপর নগরায়ণের আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ স্বস্তিতে থাকলেও সিংহভাগ তেমন দূষণকে নিয়তই আলিঙ্গন করছে। এখন শীতের আমেজে পিঠা-পুলির আয়োজনে পাটায় চাল বাটা থেকে শুরু করে খড়ির চুলায় তা তৈরি করা নারীদের সেই পুরাকালের ঐতিহ্য আজও বহমান। সঙ্গতকারণে দূষণ ও স্বাস্থ্যহীনতার আবর্তে পড়তে হচ্ছে নারীকে। সঙ্গে তার গর্ভের কিংবা কোলের সন্তানটিকেও। তার ওপর অত্যাধুনিক নগরায়ণে শিল্প প্রযুক্তির যে অবিমিশ্র কার্বন নিঃসরণ তাও বাতাসের অক্সিজেনের মাত্রাকে কতখানি বিলোপ করে যাচ্ছে সেটাও এখন নগ্নভাবে দৃশ্যমান। কবিগুরুর ভাষায় সৃষ্টির অভাবনীয় প্রেরণা আর যাতনা কিন্তু নারীর দেহ মনে। আবার নব উদ্ভাবনের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়ও দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য। যা কোনোভাবেই আগামীর বাংলাদেশের জন্য শুভকর নয়। তাই বুনন শিল্পের সৃষ্টিশীল নারীরা পরিবেশ-পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে সৃজন ক্ষমতার স্বভাবগত ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার চরম বিপাকে।
ফসল তোলা ও কাঁথা শিল্প
শীর্ষ সংবাদ: