ছবি: সংগৃহীত।
তিনি ছিলেন তার সময়ের শেষ ব্যক্তি যিনি জ্ঞানের সকল পরিচিত শাখায় নিজের বিস্ময়কর অবদান রেখে পৃথিবীর সর্বকালের উন্নত প্রভাবশালী এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি নিজের সময়ের চেয়ে কতটা অগ্রসর ছিলেন তা বোঝাতে কেবল আইনস্টাইন ও অন্যান্য বিজ্ঞদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তিনিই এরিস্টটল।
এরিস্টটল ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক এবং লেখক। তাঁর জীবন, দর্শন ও আবিষ্কার অনেক বৈচিত্র্যময় এবং গভীর। এরিস্টটলের জীবনের মূল দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হল:
এরিস্টটলের জীবন:
-
জন্ম: এরিস্টটল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ সালে, গ্রিসের স্টাগিরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিকোমাচাস ছিলেন একজন চিকিৎসক, যিনি ম্যাসিডোনিয়ার রাজপরিবারের চিকিৎসক ছিলেন। এরিস্টটল ছোটবেলা থেকে গৃহশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ করেন এবং পরবর্তীতে অ্যাথেন্সে প্লেটোর স্কুল, একাডেমিতে যোগ দেন।
-
শিক্ষক ও শিক্ষার্থী: এরিস্টটল প্লেটোর প্রধান শিষ্য ছিলেন এবং প্রায় ২০ বছর একাডেমিতে শিক্ষালাভ করেন। যদিও তিনি প্লেটোর দর্শন থেকে কিছু বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা প্রভাবিত হয়েছিল প্লেটোর কাছ থেকে।
-
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট: এরিস্টটল আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। আলেকজান্ডারের পিতার রাজ্যকে সম্প্রসারণের পর, তাঁর পুত্রকে কৌশলগত ও দার্শনিক শিক্ষা দেন। পরবর্তীতে, আলেকজান্ডার যখন সারা পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে বেরিয়ে পড়েন, তখন তিনি এরিস্টটলের বিভিন্ন নথি ও লেখাগুলো পাঠ করতেন।
-
মৃত্যু: এরিস্টটল খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ সালে মারা যান।
এরিস্টটলের দর্শন:
এরিস্টটল প্রাচীন গ্রীক দার্শনশাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ছিলেন এবং তাঁর দর্শন গ্রিক দর্শনের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর দর্শনের মূল দিকগুলি হল:
- আন্তরিক দর্শন: এরিস্টটল প্লেটোর আদর্শবাদী দর্শনের বিপরীতে বাস্তববাদী চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীর সব বস্তু ও ঘটনা বাস্তব এবং স্পর্শযোগ্য, এবং সেগুলি জানার জন্য যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য।
- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: তিনি যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণা করতে আগ্রহী ছিলেন। এরিস্টটল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা, প্রাণী এবং উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ করেন এবং তা থেকে আইনাবলী বের করার চেষ্টা করেন।
- এথিকস বা নৈতিক দর্শন: এরিস্টটল তার "নিকোমাচিয়ান এথিকস" (Nicomachean Ethics) বইয়ে নৈতিকতার তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তিনি মানব জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে 'এুদাইমনিয়া' (Eudaimonia), বা সঠিকভাবে জীবনযাপন ও সুখী হওয়া, বর্ণনা করেন। এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, নৈতিক জীবন আদর্শ চরিত্রের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
-
লজিক: এরিস্টটল 'সিলোগিজম' (Syllogism) বা যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর "অর্গানন" (Organon) গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ধরনের যুক্তির উপকরণ এবং পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন।
-
রাজনীতি: এরিস্টটল রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছিলেন। তাঁর "পলিটিকস" (Politics) গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ধরনের সরকারব্যবস্থা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি গণতন্ত্র, অগণতান্ত্রিক শাসন, রাজতন্ত্র ইত্যাদির মূল্যায়ন করেছিলেন এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ সরকার ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছিলেন।
এরিস্টটলের আবিষ্কার ও অবদান:
- জীববিদ্যা: এরিস্টটল জীববিদ্যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রাকৃতিক দুনিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন এবং প্রাণীজগতের শ্রেণীবিভাগ করেছিলেন। তাঁর এই কাজ পরে আধুনিক জীববিদ্যার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য হয়।
- রসায়ন: যদিও আধুনিক রসায়ন তখন অনেক পরিণত হয়নি, তবে এরিস্টটল চারটি মৌলিক উপাদান (পানি, আগুন, বাতাস, এবং মাটি) নিয়ে রসায়নের প্রাথমিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন।
- লজিক ও তত্ত্ব: তার সিলোগিজম তত্ত্ব আধুনিক যুক্তি, গণিত, এবং দর্শনে প্রভাব ফেলেছে। যুক্তির বিভিন্ন ধরনের ধাপ, শর্ত ও সম্পর্কের বিশ্লেষণ তাঁর কাজের মধ্যে পাওয়া যায়।
- রীতিবিজ্ঞান: তাঁর নৈতিক দর্শন ও রাজনীতি আধুনিক সমাজতন্ত্র ও অধিকার তত্ত্বের মধ্যে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
এরিস্টটলের দর্শন এবং আবিষ্কার প্রাচীন গ্রীসের পরবর্তী শতাব্দীগুলোর দর্শন, বিজ্ঞাপন, রাজনীতি, এবং বিজ্ঞানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
নুসরাত