ধোঁয়া ওঠা ভাঁপা পিঠার ঘ্রাণ মনে করিয়ে দিচ্ছে পৌষ এসেছে
‘পউষ এলো গো! পউষ এলো...।’ বছর ঘুরে আবারও এসেছে পৌষ। এসেছে শীতও। কবিগুরুর ভাষায় : ‘লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে।’ পৌষে শুরু হওয়া কাঁপন মাঘ পর্যন্ত নিশ্চিত চলবে। কারণ এই দুই মাস শীতের কাল। প্রথম মাস পৌষের ছয়দিন ইতোমধ্যে গত হয়েছে। আজ রবিবার সপ্তম দিন। এক সপ্তাহে প্রকৃতিতে বেশ প্রভাব পড়েছে মাসটির। মানুষের জীবনকেও কম প্রভাবিত করছে না এবারের পৌষ। ‘এবারের পৌষ’ কেন বলছি সে কারণ পরে উল্লেখ করা যাবে। তার আগে বলি, পৌষ ঘিরে একটি প্রবাদ খুব প্রচলিত। কথায় কথায় মানুষজনকে বলতে শোনা যায় ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।’ সারা বছরই এই প্রবাদ শোনা যায় বটে। এখন পৌষ মাস যেহেতু, প্রবাদটি শোনানো বা শোনার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়!
না, ‘কারও পৌষ মাস’ কথাটির উৎস অনুসন্ধানে নেমে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা যায়নি। তবে একটি অনুমান আমলে নেওয়ার মতো, যেখানে বলা হচ্ছে, পৌষ মাসে গৃহস্থের ঘরে ঘরে নতুন চালে পিঠাপুলি পায়েস ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। খেজুর গাছে বাঁধা হাঁড়ি মিষ্টি রসে পূর্ণ হয়ে যায়। এই রস থেকে হয় সুস্বাদু গুড়। পিঠা-পায়েস তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। পৌষ মাসে গ্রামীণ জনপদে ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলার আয়োজন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তির মতো প্রাচীন উৎসবে মাতে বাঙালি। এসব উৎসব-অনুষ্ঠানে মেতে থাকেন যারা, যারা পিঠাপুলির স্বাদ নিতে পারেন তাদের জন্য মাসটি দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আনন্দের সীমা থাকে না এই মানুষগুলোর। অন্যদিকে ‘কারও সর্বনাশ’ কথাটির মাধ্যমে শীতে কষ্ট পাওয়া হতদরিদ্র মানুষের কথা বলা হয়ে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ এই পৌষ মাসেই শীতের প্রকোপ বাড়ে। গৃহস্থ বাড়ির লোকেরা শীত প্রতিরোধ করতে বেশ সক্ষম। কিন্তু চালচুলোহীন গরিব মানুষেরা পৌষের রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। ঠান্ডায় শরীর জমে যায় তাদের। ফলে পৌষ গরিবের জন্য সর্বনাশা। সার্বিক অর্থে বলা যায়, একই বিষয় যখন কারও জন্য সুখকর হয়, অন্য জনকে কষ্ট দেয় তখনই ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
‘এবারের পৌষ’ প্রসঙ্গে ফিরি। পৌষের আগের মাসগুলো রাজনৈতিকভাবে যারপরনাই ঘটনাবহুল ছিল। সেইসব ঘটনার প্রভাব গাঢ় হয়ে পৌষের ওপর এসে পড়েছে। কোনো কোনো মানুষের জীবন রূপকথার মতো বদলে গেছে। চিন্তায় ছিল না এমন প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বসিত তারা। আবার বিপরীত দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, অনেকের জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ছারখার হয়ে গেছে। অর্থাৎ ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ!’
পৌষের দুই বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথও। কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে/শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে।’ অর্থাৎ, একদিকে আনন্দ গান। অন্যদিকে, শরীরে শীতের কাঁপন। কবিগুরু আনন্দের দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য জায়গায় লিখেছেন, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়।’ বিষাদের দিকটি ফুটে উঠেছে অন্য একটি কবিতায়, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘বিষাদের প্রতিমূর্তি হে শীত, সবুজের পোশাক খসিয়েছ/নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়।’
প্রিয় এসব কবিতা এবং প্রবাদ মিলিয়ে নিন। মিলিয়ে নেওয়ার সময় এখনই!