ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:৪০, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি

খুলনার সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক অনাদিকালের ও ঐতিহাসিক। এই সম্পর্ক এতটাই পুরাতন যে দিনক্ষণও সঠিকভাবে জানা অসম্ভব। বলছি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার পরিবারের কথা। খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে বিয়ে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে এই গ্রামেই বিয়ে হয় কবির। অর্থাৎ দক্ষিণডিহি একদিকে বিশ্বকবির মামার বাড়ি, অপরদিকে শ্বশুরবাড়ি। এছাড়া গ্রামটি নানাভাবে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। অপরদিকে খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে কবির পূর্বপুরুষের ভিটা। যেখানে এখনো তার বংশভূত মানুষের বসবাস। বর্তমানে এই দুটো স্থানই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেখানে ২৫শে বৈশাখ ও ২২শে শ্রাবণে নানা আয়োজনে যথাক্রমে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন ও কবিপ্রয়াণ দিবস পালিত হয়। তিনদিনে বসে লোক ও কারুশিল্প মেলা। নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক কি না হয় সেখানে। এতদাঞ্চলের মানুষকে এক সুতায় বেঁধে রাখে সেই অনুষ্ঠান। তাইতো রবীন্দ্রপ্রেমীরা মনে করেন খুলনার রূপসা উপজেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি, ‘কুশরী’ থেকে ‘ঠাকুর’, পিঠাভোগ থেকে জোড়াসাঁকো এবং দক্ষিণডিহি থেকে শান্তিনিকেতন।

ফুলতলার দক্ষিণডিহি

একটি গ্রাম একটি বাড়ির কারণে বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছে। সেটি হচ্ছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি। তবে আর পাঁচটি গ্রামের মতোই দক্ষিণডিহি। সরু ও আঁকা বাঁকা রাস্তা, নারিকেল, সুপারি জাম, জামরুল গাছে ভরপুর গ্রামটি। এছাড়া সবুজ ধানখেত, পাখিদের কলকাকলি, সব মিলিয়ে নয়নমনোহর গ্রামীণ দৃশ্যপট। যদিও বর্তমানে ইট পাথরের কিছু ইমারত বিদ্যমান।
এছাড়া বিশ্বকবি মাতামহ দিগম্বরী দেবীর বাড়ি ছিল এই এলাকাতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী জন্মগ্রহণ করে ছিলেন এই দক্ষিণডিহি গ্রামে। ছিলেন রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মামা বাড়ি শ্বশুরবাড়ি থেকে মাত্র আঁধা কিলোমিটার দূরে। এমনকি পূর্বপুরুষ পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী এ গ্রামের পতিত ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করার অপরাধে জাতচ্যুত হয়ে শ্বশুরালয়ে ওঠেন এবং সেই সুবাদে দীর্ঘদিন বসবাসও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এই গ্রামেরই মেয়ে। যৌবনে কবি কয়েকবার মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি মামা বাড়িতে এসেছিলেন।
খুলনা শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা বাজার, সেখান থেকে তিন কিলোমিটার পেরিয়ে আর যশোর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পূর্ব দক্ষিণে বেজেরডাঙ্গার দক্ষিণডিহি গ্রাম। গ্রামের ঠিক মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য একটি দোতলা ভবন। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে ব্রিটিশ ঘরানার বাড়িটির আভিজাত্য ও পরিপাট্য নজর না কেড়ে পারে না। সেখানেই রয়েছে ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’। দুই তলাবিশিষ্ট এ কমপেক্সের নিচতলায় লাইব্রেরি বা পাঠকক্ষ আছে। আছে ৫ শতাধিক বই। ওপরতলা ও নিচতলায় তথ্য বোর্ডও আছে। আছে রবি ঠাকুরের চিত্রকর্ম ও হস্তলিপি পাণ্ডুলিপি। শিলাইদহের মতো সমৃদ্ধ না হলেও বাংলাদেশে রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর বা শাহজাদপুর থেকে হেন কম নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি পরিবেশ। জরাজীর্ণ দ্বিতল ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ মূর্তি।
দোতলা বাড়িটির নিচে কক্ষ আছে ছোট-বড় চারটি। ওপরে দু’টি। চারদিকে বারান্দা। একটি চিলেকোঠা। পেছনে রয়েছে একটি শৌচাগার। খাঁজকাটা দরজা, লোহার গ্রিলের যে অংশটুকু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেগুলোতে অবিকল সংস্কার করা হয়েছে। সামনে বড় একটি খোলামেলা বারান্দা। তাতে মনের আনন্দে লুটোপুটি খেতে থাকে সোনালি রোদ। ঘরজুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। কমপ্লেক্সের মোট জায়গা তিন একর ১৪ শতক। ভবনটির নিচতলায় আটটি জানালা এবং প্রথম তলায় ২১টি জানালা রয়েছে। নিচতলায় মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ১৩ ফুট। দোতলায় সাতটি দরজা, ছয়টি জানালা ও দেওয়াল আলমিরা আছে। জানা যায়, বিয়ের আগে, অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের আগে বেনীমাধব রায় চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল সেটি ছিল টিনের তৈরি। দেবীর বিয়ের পর নাকি বর্তমানে দৃশ্যমান দোতলা বাড়িটি তৈরি করা হয়। তবে কে তৈরি করেন তা স্পষ্ট করে কোথাও লেখা নেই। কেউ বলেন, বিয়ের পর নাকি রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দেন।
স্থানীয়রা জানায়, এরপর দ্বিতল ভবনসহ এই জমির সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। একইসঙ্গে সম্পত্তি চলে যায় দখলদারদের হাতে। দীর্ঘ প্রায় চার যুগ অন্যদের দখলে থাকার পর ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাড়িটি অবৈধ দখলমুক্ত হয়। তখনকার খুলনার জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হকের উদ্যোগে ফুলতলা উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা সুলতানা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিতাভ সরকারসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সহায়তায় বাড়িটি মুক্ত করা হয়। এ সময় কাজী রিয়াজুল হকের নেতৃত্বে ফুলতলায় সুধীজন, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে এক মতবিনিময় সভায় ওই বাড়িটিকে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভূতপূর্ব সমাদৃত কাজটি সম্পাদক করেছিলেন বলে এখনো এতদাঞ্চলের সাংস্কৃতি মনা মানুষ কাজী রিয়াজুল হককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। পরবর্তীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন কাজী রিয়াজুল হক।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি অর্জন করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার ফেস্টুন, স্মারক ও প্রচারপত্রে দক্ষিণডিহির নাম সংযুক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ৮ আগস্ট বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। পরে অধিদপ্তর দক্ষিণডিহিতে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪৯ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয় ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। ওই টাকা দিয়ে ২০১২ সালের মাঝামাঝি ভবন সংস্কার, একপাশে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য কাজ করে।  

রবীন্দ্রনাথ ও দেবীর পরিণয়

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ), ব্রহ্ম মতে জোড়াসাঁকোর নিজ বাড়িতে ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায় চৌধুরী ও দাক্ষায়নী দেবী দম্পতির একমাত্র কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তার ডাক নাম ছিল ফেলী। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। এর আগে ১৮৮২ সালে পূজার ছুটির সময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হয়ে বাস্তুভিটা দেখবার অজুুহাতে যশোরের নরেন্দ্রপুর আসেন। উদ্দেশ্য কাছাকাছি পীরালী পরিবারের মধ্য হতে বধু সংগ্রহ। জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে কাদম্বী দেবী, বালিকা  ইন্দ্রানি, বালক  সুরেন্দ্র নাথ ও রবীন্দ্রনাথ আসেন পুরাতন ভিটা দেখতে।
দক্ষিণডিহি গিয়ে তারা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে দেবেন্দ্রনাথের সেরেস্তার কর্মচারী বেনীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ফেলীকে পছন্দ হয় তাদের। ফেলীর বয়স তখন ১০-১১। আর রবীন্দ্রনাথের ২২। অবশ্য ঠাকুরবাড়ির বধূদের আরও কম বয়সে বধূ করে আনা হতো তখন। যাই হোক পাত্রী রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কিনা সেটা নিয়েও গল্প প্রচলিত আছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনী ঘেঁটে জানা যায়, নিজের বিয়ের ভার তিনি বৌদিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মামা নিরাঞ্জন রায় চৌধুরী ও হিরণ্ময় রায় চৌধুরীর মাধ্যমে কন্যাহ্বানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাদের বিয়ে হয়।
রাস্তার দুই পাশে দেবদারু, সেগুন,
শিরিশ, মেহগনি সবুজ গাছের সারি।
‘কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবিড়
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই লাইন খোদাই করা আছে তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ ভাস্কর্যে।

কেন দক্ষিণডিহির সঙ্গে জোড়াসাঁকোর
এত সম্পর্ক

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে খুলনার পীরালী ব্রাহ্মণদের বংশের সখ্য ছিল বেশ। বিয়ের ক্ষেত্রে খুলনার বেজেরডাঙ্গা দক্ষিণডিহির মেয়েদের পছন্দ ছিল ঠাকুর পরিবারের। পূর্বসূরিদের অনুসরণে ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী খুঁজতে খুঁজতেও তাই তার মামা বাড়ি দক্ষিণডিহি আসা। রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী এই গ্রামের মেয়ে।
বৌদি যশোরের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী) আরেক বৌদি কাদম্বরী দেবী, ভাইজি ইন্দিরা ও ভাইপো সুরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর অছিলায় দক্ষিণডিহি আসেন। তবে ইন্দিরা দেবী ও রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, আসল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী দেখা। জ্ঞানদানন্দিনী আবার ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে স্টাইলিশ নারী। পোশাক-আশাকে রীতিমতো বিপ্লব ঘটান তিনি। সেই স্মার্ট বৌদির কাঁধেই পড়ে রবির পাত্রী দেখার ভার। বিয়ের আগে পাত্রী যায় কলকাতা। বিয়ে হয় ছেলের বাড়িতে। একইসঙ্গে বিয়ের পর মৃণালিনী একবার বাপের বাড়ি এসেছিলেন বলে জানা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ বিয়ের পর একবারও এসেছিলেন কিনা তা কোথাও পাওয়া যায় না। এক মামলার সাক্ষ্য দিতে একবার যশোর এসেছিলেন বলে জানা গেলেও শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায় না। বাড়িতে ঢোকার মুখে সিঁড়ির দু’পাশে মৃণালিনী ও রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তির দিকে তাকালে মনে হয়, ঠাকুর বাড়ির একটি ঐতিহ্য ছিল। অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই- বিষয়টি একেবারে ঠিক না।

পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের ভিটা

অপরদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃপুরুষের আবাসভূমি খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার অন্তর্গত ঘাটভোগ ইউনিয়নের পিঠাভোগ গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধরের মধ্যে দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী ভৈরব-তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারানাথ কুশারীর দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর বংশের আদি পুরুষ। যিনি খুলনা জেলার ফুলতলার দক্ষিণডিহি নিবাসী শুকদেব রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করে পীরালি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে ‘বৈবাহিক দোষে দুষ্ট’ হয়ে জাতিচ্যুত হন। পরে তিনি দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনে বাধ্য হন। জগন্নাথ কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের মার্চ মাসে পিঠাভোগের ওই স্থানকে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ’ হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই বছরের ২১ এপ্রিল খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেখানে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ’ হিসেবে নোটিস টানিয়ে দেওয়া হয়। তবে এর আগেই পিঠাভোগে একটি একতলা ভবন নির্মিত হয়। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের কাছে পিঠাভোগ গ্রাম সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। লোকেন্দ্রনাথ পালিত ছিলেন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক প্রশান্ত কুমার পালের ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুলনায় আসেন। কবে খুলনায় আসেন সে তথ্য অবশ্য নেই। তবে ঠাকুরবাড়ির ক্যাশ বইতে ১৯০০ সালের ৩১ আগস্টের হিসেবে উল্লেখ ছিল, ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র বাবু মহাশয়ের খুলনায় যাতায়াতের ব্যয় ১৬ টাকা।’ প্রশান্ত কুমার পালের ‘রবিজীবনী’ ষষ্ঠ খণ্ডের মাধ্যমে আরও জানা যায়, ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ আরও একবার খুলনায় আসেন। তবে সেবার বেড়াতে আসেননি। একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে খুলনায় আসেন। ১৯০৮ সালের ৩১ জুলাই খুলনার সেনহাটি স্কুলের শিক্ষক হীরালাল সেনগুপ্ত ‘হুঙ্কার’ নামে একটি গীতিগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ওই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ লেখাটি সংযোজিত হয়।
ইতিহাসবিদদের মতে পিঠাভোগ প্রাচীন যশোর জেলার বর্তমান খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার একটি সুপরিচিত গ্রাম। সবুজ শ্যামলিমায় ভরা এ গ্রাম। ১৯৯৪ সালে রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষের একটি কারুকার্যময় সুদৃশ্য দ্বিতল ভবন খুলনার জনৈক ব্যবসায়ী ২ লাখ ২৪ হাজার টাকায় ক্রয় করে ভেঙে নিয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় খানজাহান আলীর আগমনের প্রায় দুই শতাব্দী আগেই এখানে জনপদ গড়ে ওঠে। কুশারী বংশের ইতিহাসও বেশ বিস্তৃত। ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র প্রণীত এতদাঞ্চলের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ যশোর-খুলনা ইতিহাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে পয়োগ্রাম কসবা অধ্যায়ে বিশ্বকোষের পীরালী বিষয়ক অংশ এবং টিডব্লিউ ফ্যাবেলের ‘দি টেগোর ফ্যামিলি’সহ বিভিন্ন গ্রন্থে বলা হয়েছে রবীন্দ্র পরিবারের পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন কুশারী পৈত্রিক বাড়িঘর ছেড়ে কলকাতা চলে যান। উদ্যমী কুশারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নেন।
তখনকার সেই জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হকই রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পি বি রায়, উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম পিঠাভোগের কুশারী বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন পাঠায়। পরে কাজী রিয়াজুল হকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং অর্থায়নে পিঠাভোগের গৌরন্দ্র কুশারী ও বরুন কুমার কুশারীর কাছ থেকে ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর ২৬ হাজার টাকায় পোনে দশমিক ১৫ একর জমি রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালার পক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রয় করেন। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর সরকারিভাবে পিঠাভোগ নির্মিত হয় রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য ও রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। সেই থেকে পিঠাভোগে ঘটা করে পালিত হচ্ছে কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। অবশ্য পরে ২০১৮ সালের ৮ মে পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া জেলা প্রশাসক আমিন উল আহসানকে সঙ্গে নিয়ে নতুন ভাবে উদ্বোধন করেন। যার পরিকল্পনায় ছিলেন রূপসা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দীন বাদশা এবং নির্দেশনায় ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইলিয়াছুর রহমান।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথের পাঁচকাল

প্রাক কথা ॥ বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্র্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলি নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ড চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত।
শিশুকাল ॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের এক ধণার্ঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পীরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ ইংরেজি ১৮৬১ সালে ৭ মে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছু কাল পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তার ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা।
শৈশব ও কৈশোর ॥ ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। ১৮৭৩ সালে ১১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে আসেন শান্তিনিকেতনে। পরে পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথ তাকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য ও নাটক এবং উপনিষদ পাঠেও উৎসাহিত করতেন। ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলো হলো মাইকেল মধুসূদনের ‘মঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি এবং ভিখারিণী ও করুণা নামে দুটি গল্প। রবীন্দ্রনাথের ভিখারিণী গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী।
যৌবন ॥ ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। এই সময় ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর সন্তান ছিলেন পাঁচজন, মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়াা জেলা), পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারিগুলোর তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন।
মধ্য জীবন ॥ ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আশ্রমের আম্র্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’, ‘ব্রহ্মচর্যাশ্র’ নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ২০৯ বছর বয়স কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তার জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ একাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘স্যার’ উপাধি (নাইটহুড) দেয়।
শেষ জীবন ॥ জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের মোট ৫০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী ও পত্রপুট (১৯৩৬) এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি। একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬, চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ), শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী তিনি লিখেছেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তার শেষ তিনটি উপন্যাসও দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) এই পর্বে রচনা করেছিলেন। তার অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা। এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলোতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার কাব্যেও। সে (১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে। জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ চার বছর কবির শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ছিল ও এই দুরারোগ্য অসুস্থতা মোট দুই বছর বেশি অসুস্থ ছিলেন। ১৯৩৭ সালের শেষদিকে তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন ও এরপর দীর্ঘ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। তিন বছর পর ১৯৪০ সালে আরেকবার ভালো রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন যা থেকে আর আরোগ্য লাভ করতে পারেননি। এই সময় রচিত কবিতাগুলো ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শেষকথা ॥ রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। মানব কল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্র্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গান দুইটি যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণের নেশা ছিল প্রখর। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সনের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, জাপান, মেক্সিকো, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইরান ও ইরাক অন্যতম। কবিগুরু আমাদের দিয়েছেন কথা, সুন্দর দেখার দৃষ্টি ও জন্মভূমিকে ভালোবাসার বোধ।

প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা অফিস

×