ইসরাত জাহান সৃষ্টি। সপ্তম শ্রেণি শেষ করার পূর্বে বিয়ের পিঁড়িতে। দুই বছর না ঘুরতে সংসার ভেঙে যায়। সংসার ভেঙে যাওয়ার পূর্বে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি। না, তবু টিকাতে পারেনি সংসার। দুই বছর সংসার জীবনের স্মৃতি বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সৃষ্টি বলেন, সংসার জীবনে স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতন কাকে বলে সেটা হারে হারে বুঝেছি। তবুও সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কারণ পরিবারের অবাধ্য হয়ে সপ্তম শ্রেণি পড়াকালীন বিয়ের পিরিতে বসে ছিলাম। সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে স্বামী-শাশুড়ি আমাকে একাধিক বার হত্যার চেষ্টা করে। কিন্ত ভাগ্যগুণে বেঁচে যাই। পরিশেষে আমার স্বামী রুমের দরজা আটকিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে পেটে ছুরি এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু ভেবে রেখে দেয়। সেদিনের সেই ভয়ংকর যাত্রায় আমি বেঁচে যাই। তবে ৮ মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলাম। সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার সংসার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সৃষ্টি বলেন, বিয়ের বয়স না হতে ঘর ভেঙে যাওয়া একটি মেয়ের জন্য কি যন্ত্রণা সেটা আমি বুঝেছি। সেই থেকে মা-ভাইয়ের সংসারে। বাবা হারা ছোট বেলা থেকে। এর মধ্যে আমি তাদের সংসারে অতিরিক্ত বোঝা। মা আমাকে বোঝা না ভাবলেও ভাই-ভাবির মুখের কথা, আচার-আচরণ থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু করার নেই। কাকে বলব। কাউকে আমার মনের জ্বালা-যন্ত্রণার কথা বোঝাতে পারি না। পাড়া প্রতিবেশীর কাছেও না। শত যন্ত্রণা-কষ্টের মাঝে আবার শুরু করি পড়ালেখা। পাস করি এসএসসি-এইচএসসি। ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে আছি। পড়ালেখার পাশাপাশি গোয়ালন্দ মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সালমা ম্যাডামের পরামর্শ ও সহযোগিতায় সেলাই প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমি গবাদিপশু পালনের ট্রেনিং, আনসার ভিডিবি থেকে ট্রেনিং নিয়ে থাকি।
ট্রেনিং নিয়ে শুরু করি হাঁস-মুগরি, কবুতর ও বিভিন্ন জাতের পাখি পালন। কিছু দিনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করি। বাড়ির আঙিনায় রাজহাঁস, ছাগল এবং বাসার ছাঁদে মুরগি এবং কবুতরসহ বিভিন্ন প্রকার পাখি পালন করতে থাকি। পাশাপাশি বাইরে থেকে সেলাই কাজ সংগ্রহ করি। ৬ মাসের মধ্যে আয়ের মুখ দেখতে শুরু করি। সেই থেকে আমার প্রয়োজনীয় সকল প্রকার জিনিসপত্র আয়ের টাকায় করি। মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সালমা ম্যাডামের সঙ্গে সুসম্পর্ক হওয়ার কারণে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন ইউনিসেফের সাহায্যে পুষ্ট একসিরেটিং প্রটেকশন ফর চিলড্রেন (এপিসি) প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হয়। এখন প্রতিদিন সকালে হাঁস-মুরগি, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রকার পাখি দেখভাল করে সকাল ৯টার পূর্বে এপিসি প্রকল্প ‘হাব’ চলে যাই। ফিরে এসে আবার খামারে কাজ শুরু করি। এখন আমার খামার ভরা হাঁস-মুরগি, কবুতর, ডাহুক পাখি রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে আমি এখন ভালো আছি। কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় না। আমার খামারে সার্বক্ষণিক দুজন নারী শ্রমিক কাজ করছে। হয়তো আগামী বছর আমার খামারে ৮/১০ জন নারী শ্রমিক কাজ করতে পারবে। কর্ম জীবনে আসার পূর্বে বাটন মোবাইলে ফোন চালিয়েছি। এখন স্মার্ট ফোন চালাতে হয়। স্মার্ট ফোনে অনলাইনে ক্লাস করি এবং শিশু ও নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করি। স্মার্ট ফোন এবং কর্মজীবনের কাজ একাকার হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, স্মার্ট ও মেধাবী নারী-পুরুষ ঘরে বসে থাকলে অকর্ম হয়ে যায় একটি সময়। ঘর থেকে বের হলে নারীরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। কারণ আমার সংসার ভেঙে যাওয়ার পর হতাশায় দিন-রাত কাটিয়েছি। এখন আমি একটি মুহূর্ত সময় পাই না। সব সময় কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। স্মার্ট যুগে ঘরে বসে থাকলে কেউ মূল্যায়ন করবে না। সুতরাং নারীদের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আয়শা বেগম। বাল্য বিয়ের শিকার। এসএসসি পাস করার পর কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়নি। বিয়ের বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে দুই সন্তানের মা হয়েছেন। অভাব-অনটনের সংসারের ঘানি এসে পরে তার ওপর। দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে কোনো রকম দিনযাপন করতে থাকে। এরই মধ্যে কর্মের প্রয়োজনে স্বামী প্রবাসী হয়। দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে বিদেশে গেলেও ভালো অবস্থানে নেই স্বামী। অভাব-অনটনের সংসারে যোগ হলো দেনার বোঝা। বন্ধ হলো স্বামীর আয়-রোজগার। না, তবুও ভেঙে পড়েনি আয়শা। শ্বশুর-শাশুড়ি ও সন্তান রেখে সংসারের সচ্ছলতা আনার জন্য বাড়তি কাজ শুরু করেন আয়শা। কাজের পাশাপাশি সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য রয়েছে অদম্য ইচ্ছা। এরই মধ্যে বাবার মৃত্যু। বাবার মৃত্যুর পর চা ও চাচাত ভাইয়েরা সংসার চালানোর জমি নিয়ে যায়। এরই মধ্যে অবিবাহিত তিন বোনের দেখভালের দায়িত্ব। এ যেন কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা। একটি সময় আমি কাঁদতেও ভুলে গেলাম।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার রাজবাড়ী প্রতিনিধির সহযোগিতা এবং পরামর্শে আশ্রয় নেয় গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কাছে। খুলে বলে জমিয়ে থাকা সকল কথা। আশ্রয় বা কাজ চাই তার কাছে। প্রথমেই স্থানীয় সেই কর্মকর্তা যোগাযোগ রাখার জন্য পরামর্শ দেয়। কিন্ত নাছোর-বান্দা আয়শা বেগম। প্রতিদিন মহিলা অধিদপ্তরে ঘোরাঘুরি শুরু করেন। সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে কর্মকর্তার সঙ্গে।
এরই মধ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন ইউনিসেফের সাহায্যে পুষ্ট একসিরেটিং প্রটেকশন ফর চিলড্রেন (এপিসি) প্রকল্পে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় ১০৫ জন যৌনপল্লী ও পথশিশুদের নিয়ে কার্যক্রম। উপজেলা শিশু বিষয়ক এর অধউনে শুরু হয় কর্মজীবন। তবে বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাকরি জীবন সহজ ছিল না। বাবার বাড়ি ও স্বামীর বাড়িতে থাকাকালীন ছিল না মোবাইল ফোনের সঙ্গে সম্পর্ক। তবে ইচ্ছা-শক্তির কারণে হাতে তুলে নেই স্মার্ট ফোন। উপজেলা অফিস ও ঢাকা অফিসের সকল প্রকার কার্যক্রম চালাতে হয় অনলাইনে। প্রতিনিয়ত মিটিং করতে হয় অনলাইনে। কাজের দিক নির্দেশনা আসে মোবাইলে। এখন মোবাইল ফোনের একটি কর্মজীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সকালে রান্না করে সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে কর্মজীবনে ফিরে যাওয়া। আবার দিন শেষে বাড়িতে এসে কাজ করা। এর পাশে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা আয়শার চ্যালেঞ্জ। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারেও পিছিয়ে নেই আয়শা। মেয়ে মীম গোয়ালন্দ শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিও-৫ পেয়েছে। ভর্তি হয়েছেন ফরিদপুর একটি কলেজে। মীম পর পর দু’বার সকল বিষয়ে উপজেলার সেরা শিক্ষার্থী হওয়ার অর্জন করেছেন।
শুধু সৃষ্টি ও আয়শা নয়। গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শে নার্গিস, বিপাশা, আসমা ও খালেদা আজ সফল হয়েছে। একটি সময় তারা সবাই সংসারে অপ্রয়োজনীয় এবং বোঝা হয়ে ছিল। না, তারা এখন সংসারে অপ্রয়োজনীয় বা বোঝা নয়। সৃষ্টি, আয়শা, নার্গিস, বিপাশা, আসমা ও খালেদা এখন সংসারে বোঝা নয়। বরং সংসারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, কর্মজীবন বা ব্যক্তি জীবনে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। শুধু সৃষ্টি, আয়শা, নার্গিস, বিপাশা ও খালেদা নয়। ওদের মতো শত শত অবহেলিত নারী গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন টেনিং ও পরামর্শ নিয়ে কর্মজীবনে সফল হয়েছে। আগামীতেও অনেকে সফল হবে। তবে আমি সব সময় বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে। বাল্য বিয়ে বন্ধ করা আমার নৈতিক ও গুরুদায়িত্ব।
রাজবাড়ীর সফল নারী
শীর্ষ সংবাদ: