নারী স্বাধীনতার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকে ক্ষমতায়ন বিষয়টি। বৈষম্যপীড়িত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর বিভিন্ন অধিকার আর প্রাপ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া আজও ঠেকানো গেল না। সমসংখ্যক নারীর ক্রমাগত বঞ্চনার ইতিহাস সময়ের নির্মম যাতনা। শিল্প প্রযুক্তির আধুনিক যুগ পরম্পরায় অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন নজরকাড়া সন্দেহ নেই। কিন্তু কাঠামোর অভ্যন্তরে যে সব অপসংস্কার আর পুরনো আমলের বিধিনিষেধ টিকে আছে। যা নতুন সময়কে সমস্যার আবর্তে ফেলে দিচ্ছে। নারী স্বাধীনতা দীর্ঘকাল সমস্বরে উচ্চারিত এক অপরিহার্য অধিকার। যা সব মানুষই জন্মগতভাবে অর্জন করে। কিন্তু পুরো সমাজ যখন অযাচিত বৈষম্যের চরম দুর্ভোগে পড়ে সেখানে নতুন করে আওয়াজ ওঠে সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ যুগ ও কালের যৌক্তিক অবয়ব। যা কোনো অংশকে পেছনে ফেলে দেবে না। অধিকারের মাত্রায়ও কেউ বাড়তি কোনো সুযোগই পাবে না। সেখানে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দৃষ্টিকটুভাবে হরেক তফাৎ নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামোয় যে আঁচ ফেলে তাই যে কোনো অংশকে মানুষের মর্যাদায় দাঁড়াতে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। জন্মগতভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই স্বাধীন সত্তায় জগতের আলো দেখা সৃষ্টির ঊষালগ্নের এক অবারিত সম্ভাবনা। কিন্তু এক সময় সেখানে বিভেদের প্রাচীর তৈরি হওয়াও অমানিশার অন্ধকার। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যগগনে। কিন্তু চলে আসা নানামাত্রিক বিভাজন জিইয়ে থাকাও এক ক্রান্তিকালীন দুঃসময়। বিভিন্ন বৈষম্য ঘুচাতে আমরা ’৪৭-এর দেশ বিভাগ প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানে যথার্থ সমান অধিকার অর্জিত না হওয়ায় আপামর বাঙালি নিরবচ্ছিন্ন কর্মযোগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে অযাচিত রবীন্দ্র বিরোধিতা ঠেকাতেও রাস্তায় নেমে আসা এক সাংস্কৃতিক জোটবদ্ধতা। ভাষা আর সংস্কৃতির প্রশ্নে কোনো বিভাজন বাঙালিরা কখনো আপোসই করেনি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন। পরবর্তীতে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আপামর বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথে দিয়ে যে আন্দোলন এগিয়ে যায় ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম তারই অনন্য লড়াকু যাত্রাপথের অংশীদার। ১৬ ডিসেম্বর বহুকাক্সিক্ষত বিজয় দিবস আমাদের যে উপহারে অবদানে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তা আজও এক সমতার লড়াই। আমরা অতিক্রম করছি বিজয়ের মাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বাধীনতা অর্জনের তেপান্ন বছরেও কত অসমতা, আবর্জনা কাঠামোর অভ্যন্তরে বিদ্যমান সেটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আজও সমতার লড়াই শেষ না হওয়াও পরিস্থিতির দুর্বিপাক। বিশেষ করে নারী-পুরুষ বৈষম্য। যা সৃষ্টির ঊষাকালের এক অবিচ্ছিন্ন বিভেদের বহির্প্রকাশ। যা আজও থামানো গেলই নাÑ বরং নিত্যনতুন তারতম্যের হিসাব-নিকাশে সমসংখ্যক নারীর যে বিপন্নতা তাও উঠে আসছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, আলোচনা সভায়। ক্ষমতায়নে নারীরা কতখানি এগিয়ে কিংবা দক্ষ, যোগ্য। অমীমাংসিত প্রশ্নটি যথার্থ উত্তর মিলতে আরও কত সময় পার করতে হবে তা ভাবাই মুশকিল। এখনো প্রশ্নবিদ্ধ নারীরা আসলেই অধিকার আর স্বাধীনতার আলোকে সেভাবে ক্ষমতায়নকে ব্যবহার করতে বারবার পিছু হটছে। নারী নেত্রী সুলতানা কামাল সম্প্রতি অধিকার, স্বাধীনতা আর ক্ষমতায়ন নিয়ে সমসংখ্যকের ওপর এক বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। নতুন কোনো বিষয় কিংবা সমস্যা নয়। যুগ-যুগান্তরের এক অনধিগম্য, কণ্টকাকীর্ণ যাত্রাপথ। ক্ষমতায়ন আসলেই যে কোনো একটি অংশের শক্তি প্রয়োগ আর বৃদ্ধি করা। কিন্তু সেটা সমাজের কোনো অংশ কিংবা কারা তেমন শক্তিকে লালন-ধারণ করছে। আপাতদৃষ্টিতে সেটা কিন্তু পুরুষের হাতে। নারীরা ক্রমশ শক্তি ধারণ আর প্রয়োগ করলেও এখনো অবারিত স্বাচ্ছন্দ্যভাবে এগিয়ে নিতে পিছু হটার দৃশ্যও অস্বস্তিকর। যে কোনো মানুষের ক্ষমতায়ন নির্ভর করে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চেতনায় নিজেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সামনে নিয়ে যাওয়া। সেটা আজও সেভাবে স্বস্তিদায়ক কিংবা সাবলীল নয়। কারণ নারী শিক্ষা অগ্রসরমান এক সামাজিক বলয়। পাশাপাশি নানামাত্রিক পেশায় তাদের সচেতন অংশগ্রহণ সময়ের নির্মাল্য। যে ব্যবসা বাণিজ্যে নারীদের অংশ নেওয়া হাতে গোনায় ছিল সেখানেও আজ তারা নজরকাড়াভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে আসীন হতে নির্দ্বিধায়, নির্বিঘ্নে ছুটে চলাও সামাজিক নিরবচ্ছিন্ন অভিগামিতা। সব মানুষের অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত বিধিবদ্ধ। সেখানেও কেউ যদি অবিচার, অনিয়মের শিকার হয় সেটা আইনগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুরক্ষিত বলয় রাষ্ট্রই নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন বিপত্তি অধিকার। হরণের বেলায় তেমন দুঃসময় পার করতে হয় বিচারিক প্রক্রিয়ায়ও। আজও যথার্থ অধিকারের জন্য সমসংখ্যককে লড়ে যেতে হয়। যা কোনো পুরুষের বেলায় সেভাবে দৃশ্যমান নয়। পুরুষদের সংগ্রামী অভিযাত্রায় বিত্তের ফারাক, মর্যাদার লড়াই দৃশ্যমান হতে সময় নিচ্ছে না। যা শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অনাকাক্সিক্ষত এক দুর্ভোগ। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রথম ব্যবধান দৃষ্টিকটুভাবে নারী-পুরুষের অসমতা। যার কোনো নির্দিষ্ট কারণ কোথাও উল্লেখ নেই। তেমন বৈষম্যের কঠিন সময় মোকাবিলা করে নারীকে তার অবস্থান আর মর্যাদাকে টিকিয়ে রাখা সমাজ সংস্কারের বিধি। যার ব্যত্যয় আজ অবধি অদৃশ্য সুরাহা তো পরের বিষয়। সঙ্গতকারণে সমতার আলোকে নারীরা অধিকারহীনতা আর স্বাধীনতাচ্যুত হওয়া থেকে আইনি বিধানও পেতে পারেন। যদি তাকে সাবলীলভাবে বিধি মোতাবেক অর্জনে পিছু হটতে না হয়। সিংহভাগ নারী আসলেই জানে না তাদের অধিকার আর স্বাধীনতা একেবারেই মানুষের পর্যায়ে। স্বামী-স্ত্রীর অধিকারেও ধর্ম কিংবা রাষ্ট্র নতুন কোনো পথ দেখায়নি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন ধর্মীয় বিধি। একইভাবে সামাজিক বন্ধনও। আর মা-সন্তানের সম্পর্ক তাতেও ছেলের কাছে মায়ের কোনো অধীনতার প্রশ্নই আসেনি। মা যে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেন সন্তানকে তার দামই নাকি অপরিশোধ্য। লালন, পালন, মানুষ করা এমন সবের দামও অমূল্য রতন। হরেক আন্দোলন-সংগ্রামেও নারী সমাজের দৃষ্টিনন্দন অংশ নেওয়া দেশের সমতার ইতিহাসকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৫২ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আর সম্প্রতি ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে নারীদের যথার্থ অংশগ্রহণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার আধুনিক সমতায়নের নব অঙ্গীকার। কোনো কারণে সমসংখ্যক সামান্যতম পিছু হটলে সার্বিক আন্দোলন, বিপ্লব, উন্নয়ন কোনোটাই দৃশ্যমান হবেই না।