ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:১০, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

কাঁকন বিবি সিতারা বেগম

শুরু হয়েছে অপ্রতিরোধ্য ডিসেম্বর মাসের বিজয়ের রথ। ডিসেম্বর এলেই স্মৃতির পাতায় জ্বল জ্বল করে দীর্ঘ ৯ মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতা আর রক্তস্নাত স্বদেশভূমি। স্বাধীনতার এমন মাহেন্দ্রক্ষণ ইতিহাসের পাতাকে শুধু রক্তে রঞ্জিত করেনি, পাশাপাশি গৌরব আর প্রাপ্তির পথপরিক্রমাকেও বিভিন্নভাবে মহিমান্বিত করেছে। সমাজের সমসংখ্যক নারীও তেমন সময়ের সম্মুখ সমরই শুধু নয় বরং হরেক কর্মযোগে মাতৃভূমি সুরক্ষার দায়িত্বে নিজেদের উৎসর্গ করেন। তাও রক্তবাহিত ইতিহাসের আর এক যুগান্তকারী অধ্যায়। রণাঙ্গনের বীর সৈনিকের ভূমিকায় দায়-দায়িত্ব পালন করেও সহযোদ্ধা মুক্তি সৈনিকদের পাশে দাঁড়ানো আরও এক অবারিত কর্মসাধনা। রণকৌশলে অনভিজ্ঞ নারীরা প্রশিক্ষণে পারদর্শী হয়ে সরাসরি মাঠে- ময়দানে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করা ইতিহাসের অনন্য যাত্রাপথ বলাই যায়। পাকিস্তানি জঙ্গি হানাদার বাহিনী আর নতুন তৈরি হওয়া বীর বাঙালি সৈনিকরা যেভাবে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নারী সমাজ তেমন অংশীদারিত্ব থেকে মোটেও পিছু হটেনি। যারা রণকৌশলে সেভাবে মাঠে-ময়দানে শরিক না হয়েও বীর, লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু সাহস জোগানোই নয় বরং যাপিত জীবনে হরেক কর্মদ্যোতনায় পাশে থেকেছেন। যা ইতিহাসের আর এক দুঃসহ যাত্রা বলাই যায়। তখন অবিভক্ত পাকিস্তানি সামরিক জঙ্গি বাহিনী যেভাবে বাংলার মাটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে তাও করুণ আখ্যান। হানাদারদের জঙ্গি সেনাপ্রধান বলেছিলেন মানুষ নয় মাটিই তাদের দরকার। শুধু কি বলা? করেও দেখাতে কিছুমাত্র দমে যায়নি।
মাত্র নয় মাসে তিরিশ লাখ মানুষের মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। সেখানে নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হাতে গোনা হলেও সাহায্য-সহযোগিতায় তারাই লড়াকুদের সমান মনোবল আর দৃঢ় চেতনায় যে ভূমিকা পালন করে যান সেখানে তাদের তুলনা নিজেরাই। অভুক্ত, যুদ্ধক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাবারের আয়োজন সে সময়ের এক অনবদ্য স্বদেশ প্রেমের নিশানা। গুলিবিদ্ধ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা, শুশ্রƒষা, যত্ন-আত্তির সবই করতে হয়েছিল নারীদের। তেমন ইতিহাস স্বাধীনতা আর বিজয়ের এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে গাঁথা। এ ছাড়াও আছে নারীদের আর এক গভীর ক্ষতের করুণ ইতিবৃত্ত, যা স্বাধীনতা ও বিজয়ের চাইতেও কম দাবি নয়। নিজেদের মূল্যবান ঐশ্বর্য সম্ভ্রমহানিতার যে অসহনীয় দাবানল সেটা নয় মাসের রক্ত-সংগ্রামের আর এক দহন জ্বালা তো বটেই। তেমন দগ্ধতার পরশমনিতেই এসেছে বহু প্রত্যাশিত, অনন্য এক উপহার। উপহারই বটে। মুক্তির স্বাদে উদ্বেলিত বাঙালি যখন আনন্দের সাগরে ভাসমান সেখানে ঘটে যায় আর এক অগ্ন্যুৎপাত। জাতিকে মেধাশূন্য করতে জ্ঞান রাজ্য রক্তে বহমান করা মানব ইতিহাসের আর এক জঘন্যতম নৃশংস অভিযান। তাই বিজয়ের মাসের হিসাব-নিকাশে সামনে এসে দাঁড়ায় এমন সব মর্মস্পর্শী অঘটনের করুণ বাতাবরণ। সহযোদ্ধা ভাইয়ের সঙ্গে রণাঙ্গনে লড়াই করা নারী মুক্তি সংগ্রামী আজও ইতিহাসের রক্ত মাখানো পাতায় নিজেদের অপরাজেয় ভূমিকায় চিরস্থায়ী আসন তৈরি করে অম্লান হয়ে আছেন। সেখানে সরাসরি রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া নারীরা যুদ্ধে উন্মত্ত পাকিস্তানি হানাদারদের মোকাবিলায় দুঃসাহসিক যাত্রাপথকে আলিঙ্গন করা ঐতিহাসিক বরমাল্য হিসেবেও স্বীকৃত।
উল্লেখ করতে চাই কয়েকজন নারীযোদ্ধার অকুতোভয় সংগ্রামী অভিযাত্রা।
গণমাধ্যম কর্মী সেলিনা পারভিন। ১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া এই লড়াকু সাংবাদিক ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর দ্বারা আটক হয়ে শেষ অবধি মৃত্যুবরণ করেন। সে সময়ের হাতে গোনা কয়েক নারী সাংবাদিকের একজন। সাপ্তাহিক বেগম ও ললনার সম্পাদক ছিলেন। তবে নারী হিসেবে একদমই নয় মানুষের ভাবনায় তৈরি হওয়া এই সেলিনা শিলালিপি নামে আর এক কাগজের সম্পাদক হওয়াও নিজেকে সাবলীলভাবে এগিয়ে নেওয়া। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার চরম দুঃসময়ে তিনিও হানাদার সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত হয়ে জীবনটা শেষ অবধি আর ফিরেই পাননি। ফেনীর এক শিক্ষকের কন্যা সেলিনা মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বাল্য বিয়ের আকালে পড়া এমন অঘটন জীবনকে শান্তি-স্বস্তি দেয়নি বলে জানা যায়। বিবাহিত জীবনের ছেদ পড়ে সংসার ধর্ম পালনের মাত্র ১০ বছরের মধ্যে। জীবনের টানাপোড়েনে এগিয়ে চলা এই নির্ভীক সাংবাদিক ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও নিজের যুগান্তকারী ভূমিকায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরপর থেকে সভা, মিছিল ইত্যাদিতে নিয়মিত যোগ দিয়ে দেশের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার পরিচয় দেন। ১৯৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, আন্দোলনে তার সরাসরি অংশ নেওয়া এক অবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দ্যোতনা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এই লড়াকু দেশপ্রেমিক মানুষটি। পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ১৮ ডিসেম্বর তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। ওইদিনই তাকে আজিমপুর গোরস্তানে শায়িত করা হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নারীদের রক্তে রঞ্জিত আর এক বীভৎসতার নির্মম আখ্যান।
মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি।
কাঁকন বিবিও ১৯৭১ সালের এক বীর মুক্তিসংগ্রামী। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের দীপ্ত পদচারণায় রণাঙ্গন কেঁপে ওঠাও স্বাধীনতা সংগ্রামের যথার্থ কাহিনী। গণযুদ্ধের এই কাতারে নারীর দীপ্ত অঙ্গীকার আর পথ নিষ্কলুষ কিংবা নিষ্কণ্টক ছিলই না। নারীদের হতে হয়েছে আরও বেশি অত্যাচরিত, পদানত। মানসম্মান হারানোর পঙ্কিল অধ্যায়ের বন্ধুর যাত্রাপথ। প্রাথমিকভাবে মর্যাদা বিপন্ন এমন নারী যোদ্ধারা সামাজিক বলয়ে নিগৃহীত হওয়াও দুঃসময়ের দুর্বিপাক। যুদ্ধে বিরোচিত অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাব ও পেয়েছেন কাঁকন বিবি। সেটাও সমসংখ্যক নারীর জন্য এক অনবদ্য যাত্রাপথই শুধু নয় বিজয় গাঁথার পরম বরমাল্যও বটে। কাঁকন বিবি মূলত গুপ্তচরের ভূমিকায় শত্রু শিবিরের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতেন লড়াকু উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। কম দুঃসাহসিক বিষয় ছিল না মোটেই। ক্ষতবিক্ষত লড়াকু কাঁকন বিবি দ্বৈতভাবে গুপ্তচর আর সম্মুখ যুদ্ধে নিজের সম্ভ্রম থেকে আরম্ভ করে শক্তি, সাহস সবাই উজাড় করে দিতে দ্বিধাহীন ভাবে এগিয়ে গেছেন। ডিসেম্বরের বিজয়ের মাস শুধু উল্লাস আর আনন্দের বার্তা নয়। বরং দীর্ঘ নয় মাসের এক জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সহায় সম্বল, কাছের মানুষ থেকে নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন বীর সেনানি বঙ্গললনারা। যা গৌরব আর অগ্নিস্নানের মিলিত ধারায় দেদিপ্যমান হয়ে মুক্তিকামী মানুষের কাছে পরম বরমাল্য পৌঁছে দেয়। সিঁতারা বেগম, তারামন বিবির সম্মুখসমরের বীর গাঁথা আজও বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত। অসম সাহস, অকুতোভয় দেশপ্রেম সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতায় নারী মুক্তিযোদ্ধারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন।

×