.
অগ্রহায়ণের মায়ামাখা আবেশ পেরিয়ে পৌষে পা দিয়েছে প্রকৃতি। প্রতিবছরের মতো এ বছরের অগ্রহায়ণটা ছিল ভিন্ন। মাসের শেষেই কনকনে শীতে কেঁপেছে পুরো দেশ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল বেশিরভাগ এলাকা। কোথাও কোথাও হয়েছে মৃদু আকারের শৈত্যপ্রবাহও। খোদ রাজধানীবাসীও কাবু হয়েছেন শীতের দাপটে। পৌষের শীতের হিমেল হাওয়া আরও তীব্রতর হওয়ার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে জনজীবন যেমন শীতের দাপটে নাজেহাল হচ্ছে তেমনি বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগ-বালাইও। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-কাশিসহ নানা অসুখে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। এমন অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এই সময়টায় শিশু এবং বয়স্কদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ারও তাগিদ তাদের।
গত কয়েকদিন থেকেই রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটসহ প্রায় সব সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগীর ভিড়। সরেজমিনে দেখা যায়, এসব রোগীর বেশিরভাগই জ্বর-সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, ডায়রিয়াতে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে রোগীদের বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক।
রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৬ মাসের শিশু সন্তান তাইয়েবাকে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছেন রাজধানীর ঝিগাতলা এলাকার বাসিন্দা সুমি আক্তার ও রহমান মিয়া দম্পতি। জানান, শীত শুরুর পরপরই মেয়ের হালকা কাশি হয়। পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে বলে ওষুধ খাওয়ালেও কোনো উন্নতি তো হয়ই বরং শনিবার রাত থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ভোর হতেই তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন ভর্তি করাতে। এখানে বহির্বিভাগের চিকিৎসক বলেছেন নিউমোনিয়া হয়েছে। ভর্তি করাতেই হবে। এখন ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে সুমি আক্তার বলেন, অগ্রহায়ণ মাসে এমন শীত অনেকদিন দেখিনি। বড়রাই কাবু হয়ে যাচ্ছি। ছোটদের অবস্থা কি হবে তা তো বোঝাই যায়। তবে আমাদের ভুল হয়েছে। প্রথম দিনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে না যাওয়া। তবে ঢাকা মেডিক্যালের চিকিৎসকদের ওপর আমার অগাধ আস্থা। নিশ্চয়ই আমার সন্তান সুস্থ হয়ে উঠবে।
টনসিলের ব্যথা মাঝে মাঝেই হতো মগবাজার নয়াটোলা এলাকার বাসিন্দা রিম্পী আক্তারের ছেলের। এই শীত আসার পর তা বেড়েছে। বেসরকারি এক হাসপাতালে দেখালে ডাক্তার অপারেশনের কথা বলেন। ওখানে চিকিৎসার ওপর তেমন একটা আস্থা না থাকায় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু বহির্বিভাগের চিকিৎসক কিছু ওষুধ দিয়ে বলেছেন, শীতের তীব্রতা কমলে ব্যথা হয়তো কিছুটা কমবে। তবুও যদি না কমে তাহলে অপারেশন করাতে হবে। একই হাসপাতালে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত বাবাকে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছে বগুড়ার আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার কাশির তীব্রতা বাড়ে। আর বর্তমানে ঠান্ডার যে তীব্রতা তাতে করে বাড়িতে রাখার সাহস পাননি। প্রথমে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি থাকলেও নিজের কর্মস্থল ঢাকা হওয়ায় ঢাকায় নিয়ে এসেছেন।
এ সময়টায় সবচেয়ে বেশি রোগীর চাপ পড়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। সরেজমিনে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায় শিশু রোগীর চাপ সবচেয়ে বেশি। এসব শিশুর বেশিরভাগই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সুমন মিয়া তার ৬ মাস বয়সী মেয়ে মাইশাকে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছেন জানিয়ে বলেন, দুই বছর আগে এরকম একটা শীতের দিনে নিউমোনিয়ায় প্রথম সন্তানের মৃত্যু হয়। এ বছর তাই দেরি করিনি। মেয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসে যখনই সমস্যা বুঝতে পেরেছি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
হাসপাতালটিতে গত মাসের চাইতে রোগী অনেকটাই বেড়েছে জানিয়ে পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম বলেন, এ কয়দিনে গুরুতর নিউমোনিয়া নিয়ে দৈনিক ১৫-২০ শিশু নতুন করে ভর্তি হচ্ছে। গত পাঁচদিনে ৮০ জনের মতো নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। নভেম্বর মাসে যেখানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল নামেমাত্র সেখানে ডিসেম্বরের শুরুতেই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে বেড়েছে আইসিইউর চাহিদাও। আগের মাসের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ শিশুর অভিভাবককে অপেক্ষা করতে হয় একটি আইসিইউ শয্যার জন্য।
প্রায় একই অবস্থা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেরও। হাসপাতালটির শিশু ওয়ার্ডের একটি সিটও খালি নেই জানিয়ে এ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম মাহমুদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, তীব্র শীতে যখন কাবু পুরো দেশ তখন শিশুদের বিষয়ে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। বাড়িতে বা বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের মাথাটা ঢেকে রাখতে হবে। ছোট বাচ্চা বিশেষ করে ছয় মাসের কম বয়সী শিশুর ঠান্ডা লাগলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এ সময়টায় বাড়ে চর্মরোগীর সংখ্যাও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, তীব্র শীতের হাত থেকে বাঁচতে মানুষজন ভারি কাপড়-চোপড় পরিধান করেন। এ সব কাপড় অনেক সময় আলমারি থেকে খুলেই ব্যবহার করা হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাস শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। একইভাবে যখন শীত আসে বা শীত যায় তখন বেশকিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। এ ছাড়া আমাদের দেশের বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা হালকা শীতেও অতি-সতর্কতায় শিশুদের বেশি কাপড় পরিয়ে রাখেন। ফলে তাদের শরীরে প্রচুর ঘাম হয়। তাই বাড়ে চর্মরোগের প্রভাব।
তবে অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপ তুলনামূলক কম। হাসপাতালটিতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। তবে ঠান্ডাজনিত রোগের পাশাপাশি হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীও ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিনই। কিছু ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু নতুন করে ভর্তি হলেও তা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু না।
হাড় কাঁপানো এমন শীতে শিশু ও বয়স্কদের বাড়তি যত্নের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ সময় ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের শঙ্কায় থাকেন শিশু ও বয়স্করা। কেননা তারা ঠান্ডা পানি ও কনকনে বাতাসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাই তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। প্রথমত, শিশুদের যথাসম্ভব উষ্ণ পরিবেশে রাখতে হবে। সকালবেলা নিতে হবে রোদে। এর ফলে ভিটামিন ডি পাবার পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রাও ঠিক থাকবে। দ্বিতীয়ত, শিশুর অ্যালার্জি সমস্যা থাকলে নিতে হবে বাড়তি যত্ন। অর্থাৎ কোনোভাবেই যাতে ঠান্ডা না লাগে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন হলে ডাক্তার দেখানোরও পরামর্শ দেন ডা. লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রত্যেক শিশুকে প্রয়োজনীয় সব টিকা দিতে হবে সময়মতো। কারণ সঠিক সময়ে টিকা দিলে তা আজীবন সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক। এ ছাড়া শীতকালে শিশুদের খাবারেও মনোযোগী হতে হবে। কুসুম গরম পানিসহ ভিটামিন ‘সি’যুক্ত ফল খাওয়াতে হবে। বয়স্কদের সুস্থতায় তার পরামর্শ হলো, সবসময় পরিমিত শীতবস্ত্র পরতে হবে। বিশেষ করে বুক, কান ও পা ঢেকে রাখতে হবে গরম কাপড়ে। হাত-পায়ে মোজা পরার পাশাপাশি, ঘুমানোর সময় কানে কাপড় বা মাফলার জড়িয়ে রাখতে হবে। শীতে বয়স্কদের বেশি করে শাকসবজি খেতে হবে। কারণ গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব পূরণে সাহায্য করবে। পাশাপাশি নিয়মিত গরম দুধ ও স্যুপ শরীরকে সতেজ রাখতে সহায়ক।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। গত দুই দিনের তুলনায় অনেক কমে গেছে তাপমাত্রা।