বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান পালপাড়ার কারিগররা ব্যস্ত পিঠা তৈরির মাটির পাত্র তৈরিতে
পৌষের মিষ্টি রোদ্দুর গায়ে মাখার অনুভব তো শীতই এনে দেয়। পৌষের পরশে চারদিকে শীত জেঁকে বসতে শুরু করেছে। অগ্রহায়ণের সঙ্গে পা মিলিয়ে পৌষের কথা এলেই রসনাপ্রিয় বাঙালির মনে মজাদার সব পিঠার আয়োজন সবার আগে চলে আসে। আর পিঠার জন্য চাই চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড় ও শীতের রসসহ অন্য উপকরণের সঙ্গে যে বিষয়ে চলে আসে তা হলো পিঠা তৈরির পাত্র। পিঠার জন্য চাই মাটির তৈরি বিশেষ পাত্র। আর শীতের পিঠার আয়োজনের মতোই রমরমা ব্যস্ততা এখন মাটির পাত্র তৈরির বগুড়ার পাল পাড়াগুলোতে। অন্যান্য কাজের ফাঁকে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পালপাড়ার কারিগররা। ব্যপারীদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করছেন পিঠার বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র। পালপাড়ার কারিগরদের নিকট শীতের সময় এটি বাড়তি আয়ের উপলক্ষ এনে দেয়।
পিঠা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে আর পিষ্টক অর্থ চুর্ণিত মর্দিত বা দলিত। তবে পিঠার জন্য চাই চালের গুড়া আটা বা ময়দার সঙ্গে গুড়ের ও নারিকেলের কুড়ারা মিশ্রণের সঙ্গে অন্যান্য ব্যঞ্জন। একেক পিঠার এক উপকরণ। ঝাল পিঠার জন্য চালের গুঁড়ার সঙ্গে রয়েছে ভিন্ন আয়োজন। শীত- পৌষ পার্বণের পিঠা বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য। শীত এলেই ঘরে ঘরে চলে পিঠা উৎসবের নানা আয়োজন। লোকজ সংস্কৃতির নান্দনিক ঐতিহ্য শীতের পিঠা। গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে অগ্রহায়ণের নতুন চাল ঘরে তোলার সঙ্গে আনে পিঠা উৎসবে আবির। পিঠা শুধু রসনার জন্যই না। ঐতিহ্যের বন্ধন দৃঢ় করে। গ্রামে পৌষ পার্বণের পিঠা উৎসব আত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার রীতি আছে। প্রতিবেশী ও স্বজনদের নিয়ে পিঠার আয়োজন তাই পিঠা উৎসব এক বন্ধন গড়ে তোলে। সংস্কৃতির এই বিনি সূতার বন্ধন, যা চলছে যুগের পর যুগ ধরে। বাঙালির পিঠা উৎসব, নিজস্ব ঐতিহ্যের এক উপহারের বর্ণিল ডালা। তবে গ্রামাঞ্চলের পিঠা এখন ছুঁয়েছে শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্ট থেকে পথের উনুনে। শীতের আমেজে শহরের পিঠার দোকানগুলোতে এখন বেশ ভিড়।
তবে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র পিঠার উৎসব এই পৌষে যেমন পৌঁছে যাচ্ছে তেমনি ব্যস্ততা বাড়ছে পিঠা তৈরির মাটির পাত্রের। খুপরি থেকে মাটি কড়াইসহ নানা নামের এসব পাত্রের জোগান দিতে হিমশিম অবস্থা এখন বগুড়ার পল্লীর পালপাড়াগুলোতে। মাটির তৈজসপত্র ব্যবহার হয় না বলে সারাবছর এসব পাল পাড়া এখন দইয়ের পাত্র(খুটি সরা)ও ল্যাট্রিনের পাট (মাটি দিয়ে তৈরি এক ধরনের রিং) তৈরি হয়ে থাকে। শীত এলে শীতের পিঠা তৈরির মাটির কড়াই, খুপরি, ঢাকনি তৈরি করে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ আসে পাল পাড়ার কারিগরদের। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান পালপাড়ার পাবর্তী ও গৌতম দম্পত্তি পালপাড়ার কারিগরদের এক জন। জানালেন পাড়ার দেড়শতাধিক পরিবারের মধ্যে সবাই পিঠা তৈরির পাতিল কড়াই খুপরিসহ অন্য মাটির পাত্র তৈরি করেন না। তবে চাহিদা থাকায় পাইকারদের কথায় তাদের পিঠা তৈরির বিভিন্ন পাত্র তৈরি করতে হয়। অনেক তাদের পাড়ায় এসে কিনে নিয়ে যান। পাইকাররা ২/১ দিন পর পর এসে অর্ডার দিয়ে যায়। সে অনুযায়ী পালপাড়ার কারিগররা তৈরি করেন। পালপাড়ার নারী কারিগররা এতে মূল ভুমিকা পালন করেন। পার্বতী জানান মাটি-কাদা তৈরির কাজটি তার স্বামীই করে থাকেন। তিনিসহ অন্যরা পিঠা তৈরির মাটির পাত্র(স্থানীয় ভাষায় খোরা ও খুপরি) তৈরি করে শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করে তোলেন। তার পর পাইকারারা তাদের নিকট এসে কিনে নিয়ে গিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি বা হাট-বাজারে বিক্রি করেন। পালপাড়ার আরেক কারিগর সবিতা রানী জানান পৌষ-মাঘ মাসেই তাদের পিঠা বানানোর পাত্রের চাহিদা থাকে। একেকজন কারিগর দিনে ৪০/৫০টি পাত্র তৈরি করেন। পিঠা তৈরির এসব পাত্রের মধ্যে চিতই পিঠা তৈরির পাত্রের চাহিদা বেশি।
এ ছাড়া পাঁচ খুপরি ও সাত খুপরি নামে পিঠা তৈরির বিশেষ পাত্রের সঙ্গে ভাঁপা পিঠা তৈরির ঢাকনারও চাহিদা রয়েছে। তবে এসবই তারা শীতের সময় করে থাকেন তাদের মুল কাজের ফাঁকে ফাঁকে। শীতের ৩ মাস পিঠা তৈরির পাত্রের চাহিদা থাকে। পাল পাড়ার এই পিঠার পাত্র গ্রামের ঘরে ঘরে, তেমনি তা এখন শহরের পিঠার দোকানেও সমান কদর। পাল পাড়ার কারিগর পার্বতী সবিতা রানীদের ব্যস্ত যেমন পিঠার পাত্র তৈরিতে। তেমনি পৌষের উৎসবের ডাকে পিঠা তৈরিরও ধুমও গ্রাম থেকে সবখানে। চিতই, ভাঁপা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা তেল পিঠা, পাটি সাপটা পিঠা, ঝিনুক পিঠা, কুলশি পিঠা, ঝাল পিঠা থকে দুধ রাজের মতো বাহারি নাম ও স্বাদের পিঠায় গ্রামীণ জনপদ আন্দময়তায় মুখর হয়ে উঠছে। পিঠা তৈরির উৎসবী আমেজে এই পৌষ ডাক দিয়ে যায় সুখময় সুন্দরের নান্দনিক সময়ের চিরায়ত ঐতিহ্যের বন্ধনের সুর। যে ঐতিহ্য থেকে বাঙালিকে যেমন ভিন্নতায় দেখা যায় না তেমনি এই উৎসবী আমেজ পালপাড়ার পিঠার পাত্র তৈরির কারিগর থেকে গ্রামীন জনপদে মেলে ধরে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কথা।