ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১

ইতিহাস ফ্রেমবন্দি করেছিলেন মার্ক রিবু

মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ক্যামেরা হাতে প্রবেশ, সাহসী পরিভ্রমণে দুর্লভ ছবি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ক্যামেরা হাতে প্রবেশ, সাহসী পরিভ্রমণে দুর্লভ ছবি

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ঐতিহাসিক নানা মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী মার্ক রিবু

ভারতীয় মিত্রবাহিনী যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল তখন তাদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন বিদেশী নাগরিক মার্ক রিবু। হাতে তার অস্ত্র ছিল না। দুঃসাহসী ভ্রমণে সঙ্গী হয়েছিল ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় ঐতিহাসিক সব মুহূর্ত প্রায় ধারবাহিকভাবে ধারণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে মিত্রবাহিনী কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছিল, তাদের অস্ত্রসরঞ্জাম কেমন ছিল, কোথায় কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছিলেন সৈন্যরা- এসব বিষয়ে চমৎকার ধারণা দেয় তার আলোকচিত্র। সম্মুখ সমরের ছবি, বিজয় উদ্যাপনের মুহূর্তÑ কোনো  কিছুই বাদ যায় না তার ফ্রেম থেকে। ফলে এই ছবিগুলো স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে হাজির হয়। 
অবশ্য রিবুর তোলা দুর্লভ ছবি সম্পর্কে বাংলদেশ অনেক পরে জানতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মফিদুল হক নতুন করে সামনে এনেছিলেন ছবিগুলো। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে রিবুর ৫০টি আলোকচিত্র নিয়ে ২০২১ সালে বিশেষ প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। একই সংগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি ছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। আয়োজকদের তখন দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মার্ক রিবু। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। তার অভিযাত্রা শুরু হয় জামালপুর-শেরপুর হতে।

সেনাদের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেন তিনি। প্রত্যক্ষ করেন জামালপুরের যুদ্ধ। সবই ক্যামেরায় ধারণ করার জোর চেষ্টা চালান। রিবুর আলোকচিত্রে নতুন করে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবিতে মুখগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট। অধিকাংশই অল্প বয়সী। কৈশোর উত্তীর্ণ। কিন্তু শক্তি ও সাহসের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। গবেষণার মাধ্যমে এই বীর যোদ্ধাদের নাম পরিচয়ও হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতি দিতে অবিস্মরণীয় অবদান  রেখেছিলেন বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সেনারা। আজকের দিনে ক’জন আর তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে? বিস্মৃতপ্রায় সে ইতিহাস আবার মনে করিয়ে দেয় দুর্লভ আলোকচিত্র। অস্ত্রশস্ত্রসহ মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশ ও বিভিন্ন অপারেশন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, সেটিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন। মার্ক রিবুর আলোকচিত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার চিত্র ওঠে আসে। বাঙালির ওপর যে অন্যায় হয়েছিল তা যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায় তার ছবিতে। একইসঙ্গে ছবিগুলো মানবাধিকার লংঘন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের প্রামাণ্য দলিল। 
আলোকচিত্রের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাঙালির যুদ্ধ জয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দীর্ঘ লড়াই ও নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে চূড়ান্ত বিজয়। স্বাধীন  দেশ। দেশটিকে বাঙালির নিজের করে পাওয়া আনন্দ ক্যামেরায় ধারণ করেছেন আলোকচিত্রী। অন্যদিকে পাকিস্তানীদের পরাজয়, পিছু হটার অনেক অদেখা ছবি এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। এভাবে বাঙালির হাসি-কান্নার ইতিহাস অনন্য এক দৃশ্যকাব্য হয়ে ধরা দিয়েছে। 
অবশ্য তারও আগে ভারতের কলকাতায় ছবি তোলার কাজ করেন রিবু। সল্টলেকের শরণার্থী শিবির ঘুরে ছবি তুলেন তিনি। এসব ছবি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানবেতর জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সব হারানো মানুষের মুখ যেন পাথরপ্রতিমা হয়ে ধরা দেয় রিবুর ক্যামেরায়। এর পাশাপাশি থিয়েটার রোডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নানা কর্মকা-ের ছবি তুলেছেন তিনি। এ ছবিগুলোও যারপরনাই দুর্লভ। তার আলোকচিত্রে এপার বাংলার জন্য ওপার বাংলার মানুষের প্রচেষ্টা দেখেও অবাক হতে হয়। 
মার্ক রিবু সম্পর্কে মফিদুল হকের একটি মূল্যায়ন উল্লেখ করার মতো, যেখানে তিনি বলছেন, ‘মার্ক রিবু জগদ্বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী, তিনি মামুলি যুদ্ধ-চিত্রগ্রাহক নন, সংঘাতের নাটকীয় ছবি তোলার চেয়ে তার বেশি আগ্রহ দুঃসময়ে মানুষের বেদনা-কষ্ট-বিষাদ ও মানবিক সংগ্রামের ছবি তোলায়। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছে ক্যামেরা হাতে তার এই অভিযাত্রা, যা তাকে নিয়ে গেছে চীনে, ভিয়েতনামে, আলজেরিয়ায়, কিউবায়, ভারতে, পাকিস্তানে, মধ্যপ্রাচ্যে, ইংল্যান্ডে, আমেরিকায় এবং আরও নানা দেশে।’ 
ছবিগুলো সম্পর্কেও চমৎকার মন্তব্য করেছেন মফিদুল হক। তার ভাষ্য,  ‘ছবিতে মার্ক রিবু খুঁজে ফিরেছেন ভিজ্যুয়াল টেনডারনেস, দৃশ্যমান কোমলতা। ফলে তার ক্যামেরার চোখ ছিল অনেকের থেকে আলাদা। এই পার্থক্যই তার ক্যামেরায় জোগান দেয় শান্তি আন্দোলনের সেই শক্তিময় ছবির।’

হুমায়ুন কবির

×