কিশোর মৌয়াবিয়া।
গৃহযুদ্ধ শুরুর ১৩ বছর পর সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করল সেই দেশের বিদ্রোহী দলগুলি। ফলে শুধু আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসানই ঘটল না, মনে করা হচ্ছে- শেষ হল ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধও।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার হাই কমিশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের মধ্যেই এই যুদ্ধে অন্ততপক্ষে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অসামরিক নাগরিকের সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হিসেবে অন্য দেশে পাড়ি দিতে হয়েছে ১ কোটিরও বেশি সিরিয়ার নাগরিককে। মজার বিষয় হলো- এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল এক ১৪ বছরের কিশোরের মজা করে আঁকা এক গ্রাফিতি থেকে।
সেটা ছিল ২০১১ সাল। সিরিয়ার আশপাশের দেশগুলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ‘আরব বসন্তে’র ঢেউ। অর্থাৎ, স্বৈরাচারী শাসকদের সরাতে ব্যাপক আন্দোলন। এই সময়ই মৌয়াবিয়া সায়াসনেহ নামে এক ১৪ বছর সিরিয় কিশোর, দক্ষিণ সিরিয়ার দারা শহরের তার স্কুলের পাঁচিলে মজা করেই একটি গ্রাফিতি লিখেছিল।
সে লিখেছিল, ‘এজাক এল দোর, ইয়া ডক্টর’। আরবী থেকে বাংলা করলে যার অর্থ হয়, এবার আপনার পালা, ডাক্তার। প্রসঙ্গত, বাশার আল-আসাদ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন চোখের ডাক্তার। স্প্রে-পেইন্টে লেখা মৌয়াবিয়ার সেই গ্রাফিতি, বাশার প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল। তারা মনে করেছিল, এটা সরাসরি বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করার হুমকি। আরব বসন্তের ঢেউ, সেই দেশেও লাগল বলে, ভয় পেয়েছিল।
গ্রাফিতিটি কে এঁকেছে, তা জানার জন্য দমন-পীড়নের রাস্তায় হেঁটেছিলেন বাশার আল-আসাদ। নৃশংস প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তার পুলিশ। মৌয়াবিয়া ও তার কয়েকজন বন্ধুদের ২৬ দিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে, তাদের উপর চলে নির্মম অত্যাচার, মারধর। ওই কিশোরদের অভিভাবক এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। তাদের কন্ঠস্বরও বন্ধ করা হয় কাঁদানে গ্যাস ও বন্দুকের গুলি দিয়ে। ফল হয়েছিল উল্টো। যে ঘটনা দারা শহরেই মিটে যেতে পারত, আসাদ প্রশাসনের কঠোরতা তা ছড়িয়ে দিয়েছিল সমগ্র সিরিয়ায়। দেশব্যাপী আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদ হয় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। দারা শহরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী মানুষ বিক্ষোভ দেখান। স্থানীয় স্তরের ঘটনা মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা সিরিয়ায়। দাবি ওঠে, স্বাধীনতা এবং আসাদ শাসনের অবসানের। ফের কড়া হাতে আন্দোলন দমনের রাস্তায় হাঁটেন বাশার আল-আসাদ।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর প্রকাশ্যে গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। অগণিত সিরিয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে তাদের ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এই বর্বরতার প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী সশস্ত্র বাহিনীগুলি মাঠে নামে।
২০১১ সালের জুলাইয়ে আসাদের সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য, বাহিনী থেকে সরে এসে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ গঠন করেছিল। তবে তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। তহবিলও যথেষ্ট ছিল না। যার সুযোগে জাভাত আল-নুসরা (আল কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর সিরিয় শাখা) এবং তার পর ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি দলগুলি মাথা চাড়া দিয়েছিল সিরিয়ায়।
ফলে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়েছিল। সূচনা হয়েছিল গৃহযুদ্ধের। যে যুদ্ধে পরে যোগ দেয় আমেরিকা, রাশিয়া, তুর্কিয়ের মতো বিভিন্ন দেশ। জাভাত আল-নুসরা থেকেই আজকের হায়াত তাহরির আল-শাম গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। যাদের নেতৃত্বে বিরোধীরা অবশেষে দেশ ছাড়া করল বাশার আল-আসাদকে।
মৌয়াবিয়ার কী হল? পরে সংবাদমাধ্যমকে সে জানিয়েছিল, ঘটনার সময় সে খুব ছোট ছিল। রাজনীতির কিছু বুঝত না। পরে ১৮ বছর বয়সে সে-ও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র হয়ে বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। পরে অবশ্য, নিজের আত্মীয়দের রক্ষা করতে সে দারা শহর থেকে পালিয়ে উত্তর সিরিয়ার বিদ্রোধী শাসিত অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। বিজয়ের আশায় লড়াই চালিয়ে গিয়েছে।
২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল, ‘এক দশক পর, আমার বয়স এখন ২৬ বছর। আমি আমার সন্তানদের শেখাব কীভাবে শাসনের পতন না হওয়া পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদা না জেতা পর্যন্ত প্রতিরোধ করে যেতে হবে।’
৮ ডিসেম্বর তাঁর লড়াই শেষ হলো।
এসআর