ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

গাদ্দাফির আবেগঘন শেষ ভাষণটি শুনে কেঁদেছিল অনেক মুসলিম

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৫:০০, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

গাদ্দাফির আবেগঘন শেষ ভাষণটি শুনে কেঁদেছিল অনেক মুসলিম

মুয়াম্মার গাদ্দাফি।

খলনায়ক থেকে নায়ক হওয়া সেই লৌহমানবের নাম হচ্ছে- গাদ্দাফি। নিজ দেশের অনেক প্রজার কাছে তিনি ছিলেন ভালোবাসার রাজা। পশ্চিমাদের চোখে ছিলেন একনায়ক। ৪২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর টলে যায় মসনদ। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সমর্থনপুষ্ট বিরোধী একটি গোষ্ঠীর হাতে আটক হন তিনি। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হত্যা করা হয় তাঁকে। বলছি, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কথা।

গাদ্দাফি আরব বিশ্ব ও আফ্রিকায় ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের চক্ষুশূল। ১৯৬৯ সালে সামরিক এক অভ্যুত্থানে লিবিয়ার মসনদে বসেন তিনি। লিবিয়ার রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন গাদ্দাফি

মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০১১ সালে পতনের প্রাক্কালে গাদ্দাফি দেশের জাতীয় টেলিভিশনে একটি ভাষণ দেন। ভাষণটি এখানে তুলে ধরা হলো।

‘পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শুরু করছি। গত ৪০ বছর, হয়তো আরও বেশি সময়, এই মুহূর্তে আমি সঠিক মনে করতে পারছি না, লিবিয়ার জন্য আমার সম্ভাব্য সকল কিছুই করেছি। বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল করেছি। যখন ক্ষুধার্ত ছিল মুখে খাবার তুলে দিয়েছি। 

এমনকি মরুময় বেনগাজিকে সবুজ কৃষি ভূমি বানিয়েছি। আমি দেশকে রক্ষা করেছি রাখাল বালক রোনাল্ড রিগ্যানের হাত থেকে; যখন আমার দত্তক নেওয়া এতিম কন্যাকে সে হত্যা করেছিল, তখন আমাকে হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ব্যর্থ হয়ে অনাথ মেয়েটিকে হত্যা করল।

এরপর আমি আফ্রিকান ইউনিয়নে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ সাহায্য করলাম আফ্রিকান দরিদ্র ভাই-বোনদের সাহায্যের জন্য। সারাজীবন খেটে গেছি মানুষকে গণতন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য বোঝাতে এবং আমাদের দেশে গণকমিটি গঠন করা হয়েছিল সুশাসন নিশ্চিত করতে। হয়তো এটা যথেষ্ট ছিল না। কারণ, আমি দেখতে পারছি যে, একদল জনতা যাদের কিনা ১০তলা বাড়ি আছে, ঘরভরা জিনিসপত্র আছে, রয়্যাল স্যুট আছে অথচ তারা সন্তুষ্ট নয়। তারা স্বার্থপর এবং আরও চায়।

তারা আমেরিকাকে বলেছে, তারা এ দেশে গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতা চায়। তারা কখনো বুঝতে চায় না, এই গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতা একটা গলাকাটা ব্যবস্থা, যেখানে সবচেয়ে বড়ো ইঁদুরটা বেশি খায় আর বাকিরা অভুক্ত থাকে।

তারা বুঝতে চায় না আমেরিকায় ওষুধ ফ্রি নয়, হাসপাতাল ফ্রি নয়, শিক্ষা ফ্রি নয়, খাদ্য ফ্রি নয়, তেলের দাম কম নয়, বেকারত্বের হারও কম নয়। আমি যা করেছি তা নিয়ে অনুতপ্ত নই। হয়তো-বা কারও কারও জন্যে খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। বাকিদের আমি ঠিকই সেবা করে গেছি।

তারা তো জানে, আমি জামাল আবদেল নাসেরের পুত্র, যিনি সালাহ-আল-দ্বীন আইয়ুবির পরের ইসলাম ও আধুনিক আরবের একমাত্র সত্যিকারের নেতা। তিনি সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণভার নিয়েছিলেন তার জনগণের জন্য। আমি লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলাম আমার জনগণের জন্য। আমি কেবল তার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলাম আমার জনগণকে ঔপনিবেশিক চোরদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে, যে চোরেরা আমাদের সম্পদ চুরি করতে মুখিয়ে আছে।

আজ আমি আর্মির ইতিহাসের সর্বসেরা আক্রমণের মুখে। আফ্রিকার ক্ষুদে শিশু ওবামা আজ আমাকে হত্যা করতে চায়, আমার দেশের স্বাধীনতা হরণ করতে, আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করতে, আমাদের ফ্রি হাউজিং, ফ্রি মেডিসিন, ফ্রি এডুকেশন, ফ্রি ফুড কর্মসূচি বাতিল করতে এবং রিপ্লেস করতে চায় চুরির আমেরিকান ফর্মুলা, যেটাকে তারা পুঁজিবাদ নামে ডেকে থাকে; তৃতীয় বিশ্বের মানুষ এর সম্বন্ধে ভালোই জানে।

পুঁজিবাদ হচ্ছে সেই জিনিস যেখানে কর্পোরেশন জনগণের ওপর চলে, রাষ্ট্রের ওপর চলে শেষে জনতার শক্তি দুর্বল করে দেয়। সুতরাং আমার সামনে কোনো বিকল্প নেই।

আমি আপস করব না এবং আল্লাাহ চাইলে আল্লাহর পথেই মৃত্যুবরণ করব, যে পথ আমার দেশকে ধনী বানিয়েছে, কৃষিতে সমৃদ্ধ করেছে, খাদ্য-স্বাস্থ্য উন্নত করেছে আর আমাদের আরব-আফ্রিকার অসহায় ভাই-বোনদের সাহায্য করার সুযোগ দিয়েছে, সেই পথ ত্যাগ করে আপস করার কোনো মানে হয় না।

আমি মরতে চাই না। সত্যিই যদি সেদিন আসে, আমার কথাগুলো ছড়িয়ে দিও বিশ্বজুড়ে। আমার আজকের বক্তৃতাকেই আমার উইল হিসেবে ধরে নিও। জানিয়ে দাও বিশ্বকে যে, আমি ন্যাটোর ক্রুসেডার হামলার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম, অমানবিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম। আর ছিলাম আফ্রিকান, আরবদের পাশে আলোর রেখা হয়ে।

কখনো বোকার মতো সম্পদ ব্যবহার করিনি। আমাদের মহান মুসলিম নেতা সালাহউদ্দিনের মতো আমিও জেরুজালেমের দিকে নজর দিয়েছিলাম। পারিনি মুক্ত করতে, কিন্তু সব ধরনের সাহায্য করে গেছি এই নগর মুক্ত করতে। পশ্চিমারা আমাকে উন্মাদ-পাগল বলে অভিহিত করে। কিন্তু তারা ঠিকই জানে, সত্যি কোনো দিন চাপা থাকে না। তারা এটাও জানে, আমরা স্বাধীন জাতি। আমি এই স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার শপথ করলাম। আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতা আর দেশ রক্ষা করে যাব।

ভাই ও বোনেরা, একে অপরকে ভালোবাসতে শিখুন। রক্তপাত বন্ধ করুন। কারণ আমেরিকা, ইউরোপ আর তাদের মিত্ররা কখনো আফ্রিকার বুকে সুর্যের আলো দেখতে চায় না।"

এসআর

×