একাত্তরে ভারতের আগরতলায় জিবি হাসপাতালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে যান তৎকালীন মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল পরাশক্তি আমেরিকা। আমেরিকা বলতে, আমেরিকার সরকার। বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা যখন নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন নিক্সন সরকার দ্বিধাহীনভাবে তাতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল সাধারণ জনগণ। দেশটির জনগণ বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। এর বাইরে আমেরিকারই একজন সিনেটরের নাম বিশেষভাবে আলোচিত হয়। তিনি এডওয়ার্ড মুর কেনেডি।
হ্যাঁ, আমেরিকার প্রভাবশালী কেনেডি পরিবারের সদস্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। শরণার্থীদের জন্য কাজ করা, পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনসহ নানা ভূমিকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বতন্ত্র মর্যাদার স্থান অধিকার করে আছেন ভিনদেশী রাজনীতিবিদ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। নির্বিচারে মানুষ হত্যার এই হৃদয়বিদারক খবর পশ্চিমা বিশ্বে পৌঁছার কয়েকদিনের মধ্যেই মুখ খুলেন সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি। সে সময় সিনেটে দেওয়া তার বক্তৃতাগুলো এ ইতিহাসের অনন্য দলিল হয়ে আছে। ১ এপ্রিল সিনেটে বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রথমবারের মতো সোচ্চার হন তিনি। নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীর জটিল দিকগুলো আমি অনুধাবন করি।
কূটনীতিক ও মানবতাবাদীদের জন্য এ এক জটিল বিষয়। তাই বলে আমাদের সরকার কি এ হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানাবে না? সংঘাতের শিকার হওয়া লাখো মানুষের ভাগ্যবিড়ম্বনা নিয়ে আমরা কি চিন্তিত হব না? আমরা কি সহিংসতা বন্ধে আমাদের উত্তম সেবা দিতে চাইব না? অন্তত তেমন প্রচেষ্টা যারা নেবে তাদের সহায়তা করব না?’
একইভাবে ৩ মে মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের হুমকি মোকাবিলার আহ্বান জানান তিনি। জাতিসংঘকে তৎপর হওয়ার কথা বলেন। ১১ মে’ মানবিক মানুষের দায় ও অনুভূতির জায়গা থেকে কথা বলেন তিনি। বিদেশ নীতি-সংক্রান্ত কমিটির শুনানি চলছিল তখন। তাতে যোগ দিয়ে এডওয়ার্ড মুর কেনেডি বলেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব উপেক্ষা করার উপায় নেই।
মানুষের জীবন, অসহায় জীবন, হাজারো লাখো জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। আমরা যদি জীবন বাঁচাতে পদক্ষেপ না নেই এই বিনাশ গোটা মানবতার বিবেককে দংশন করবে।
কিন্তু এত বলার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অন্যায় অবস্থান থেকে সরে আসছিল না। উল্টো পাকিস্তান আর্মিকে অস্ত্র সরবরাহ করছিল। ২২ জুন সিনেটে এ ঘটনার ফলাফল কী হবে তা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উদ্দেশে সিনেটে এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, গণমাধ্যমের খবরে আমরা জানলাম গত রাতে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মা অস্ত্রবোঝাই করে নিউইয়র্ক থেকে করাচী যাত্রা করেছে। এটা মার্কিন নীতির চরম লঙ্ঘন। ভয়ঙ্কর বিপদ হচ্ছে এসব অস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সেই রসদ জোগাবে, যা দিয়ে তারা ইতিমধ্যে ৬০ লাখ লোককে শরণার্থী বানিয়েছে, অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।’
কেনেডি সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক বিচার বিভাগীয় উপকমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ান তিনি। আগস্টে শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখতে আমেরিকা থেকে সরাসরি ভারতে চলে আসেন। সে সময়ের নথি, পুরনো পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১১ আগস্ট মাদার তেরেসাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় একটি ফিল্ড হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তিনি। যশোর রোড ধরে এগিয়ে যান। বনগাঁ পর্যন্ত ঘুরে দেখেন। জলপাইগুড়ি, আগরতলাও তাঁর পরিদর্শনের আওতায় আসে।
এভাবে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে নিবিড় ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভয়াবহ চিত্র দেখে ভেতর কেঁদে ওঠে তার। এর প্রেক্ষিতে দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করে আমেরিকার পাকিস্তান নীতির কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। পাকিস্তানেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সব মিথ্যা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তাকে ভিসা দেয়নি পাকিস্তান।
পরে বাঙালি নিধনের নানা তথ্য প্রমাণ নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান কেনেডি। সেখানে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন কেনেডি। শুধু তাই নয়, এবার ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি অগ্রাহ্য করেন তিনি। বরং ‘পূর্ববাংলা’ বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেন।
কেনেডি সিনেটেও এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রায় ৯ লাখ শরণার্থীর মানবেতর জীবনযাপন সম্পর্কে মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন তুলে ধরেন তিনি। এ সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে’ বলে জানান। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তাদের সমর্থন দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুষ্কর্মের সহযোগী বলে কড়া সমালোচনা করেন।
ডিসেম্বরে চূড়ান্ত পরিণতি পায় মুক্তিযুদ্ধ। তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কলকাঠি নাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় আমেরিকা। চাইলে তারা যুদ্ধকে আরও লম্বা হয়তো করতে পারত। কিন্তু এডওয়ার্ড মুর কেনেডি ও তার মতো সাধারণ মানুষের চাপ হয়ত নিক্সন প্রশাসনকে পিছু হটাতে ভূমিকা রেখেছিল।
৭ ডিসেম্বর সিনেটে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন কেনেডি। বাংলাদেশের মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। বলেন, আমরা জানি পূর্ব বাংলার মানুষ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এটা ছিল গণতান্ত্রিকভাবে আয়োজিত নির্বাচন। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হন। অথচ কারাগারে বন্দি করা হলো তাকে, কেননা তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যারা তাকে বন্দি করেছে আমরা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি।
এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের ট্র্যাজেডি নয়, এটা হচ্ছে গোটা বিশ্ব সমাজের জন্য ট্র্যাজেডি। আর এই সংকট মোচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার দায়িত্ব সবার।
যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ও তাকে দারুণভাবে আনন্দিত করেছিল। বাংলাদেশের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অভিমত দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারেও সিনেটে জোরালো ভূমিকা রাখেন। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য সিনেটর স্যাক্সবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি। নিজ বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশকে আমেরিকার অনেক আগেই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল।
প্রশাসন যেভাবে উপমহাদেশের সংকট মোকাবিলা করেছে, তা ছিল সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বিদেশনীতির সবচেয়ে বড় ভুল। সময় এসেছে আমাদের নীতি পরিবর্তন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার, যে স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইনের যে কোনো বিচারে তাদের প্রাপ্য।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময় কৃতজ্ঞ বাঙালি বিদেশী বন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও অগাধ শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। বিপুলভাবে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল তাকে। বঙ্গবন্ধু নিজেও জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার জবাবে এডওয়ার্ড কেনেডি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমি এসেছি আপনাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জানতে ও শিখতে। যারা শরণার্থীশিবিরে ভয়ানক কষ্টের মধ্য দিয়ে এসেছেন, তাদের সঙ্গে আবার কথা বলতে এসেছি। জানাতে এসেছি, যারা বেঁচে আছেন, স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের বেদনা লাঘবে আমি ও আমার দেশের মানুষ পাশে আছি।’
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার অ্যাডওয়ার্ড মুর কেনেডিকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত করে। ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে ২০০৯ সালে ৭৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটি রক্ষা করে চলেছে প্রয়াত সুহৃদের পরিবার। সেই সূত্রে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তার পুত্র কেনেডি জুনিয়র। এ থেকে পরিস্কার, ভবিষ্যতেও সম্পর্কটি অটুট থাকবে। যেন তাই হয়।