গামছা, গামছা লা—গে, গামছা। পাঁচলিয়া হাটে কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে আবেদ আলীর হাঁক ডাক এখন আর শোনা যায় না। আবেদ আলীর মতো আরও অনেকেই কাঁধে ঝুলিয়ে গামছা বিক্রি করতেন এই হাটে। হাটবারে নিজের পিট লুমে তৈরি গামছা বিক্রি করে চলতো তাদের সংসার। তারা এখন আর কেউ বেঁচে নেই। কাঁধে ঝুলিয়েও কাউকে আর গামছা বিক্রি করতে দেখা যায় না। তবে তাদের উত্তাধিকারীরা এখনো বাপ-দাদার ব্যবসায়িক ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তৈরি করেন গামছা। হরেক রকম ডিজাইন ও মনকাড়া রঙের এই গামছার দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। গামছার ঐতিহ্য নিয়ে পাঁচলিয়া হাট এখন উত্তরাঞ্চলের বড় মোকাম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গামছার পাইকাররা এ হাটে আসেন। গামছা কেনেন, নিয়ে যান নিজ নিজ জেলায়। বিক্রি করেন পাইকারি এবং খুচরা দামে। শতবছরের পুরাতন পাঁচলিয়া হাটে গামছার মোকামের বয়স প্রায় ৫০ বছর। তবে এখানকার উৎপাদিত গামছাকে ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের তালিকাভুক্ত করাসহ তাঁতিদের সহযোগিতার কথা জানিয়েছে তাঁত বোর্ড।
কাকডাকা ভোর থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমে উঠে সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া গামছার হাট। গুণগতমান ভালো হওয়ায় এখানকার গামছার চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। প্রতি হাটে প্রায় ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার গামছা ও সুতা বিক্রি হয় এ হাটে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রঙ ও সুতার অনিয়ন্ত্রিত দামে গামছা তৈরি করে পুষিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। ব্যবসায় চরম মন্দাভাব। মঙ্গলবার ও শুক্রবার সপ্তাহে দুদিন ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় সকাল ৯টার পরপরই। তাই ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের তৈরি রঙ-বেরঙের গামছা নিয়ে হাটে আসেন তাঁতিরা। হাটে পাওয়া যায় এক হাত থেকে প্রকারভেদে ছয় হাত পর্যন্ত লম্বা বাহারি গামছা। চার পিসে এক থান হওয়ায় আকার অনুযায়ী প্রতি থান গামছা সর্বনিম্ন্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায় বিক্রি হয় পাইকারি দরে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা গামছা কিনতে আসেন এই পাঁচলিয়া হাটে।
তাঁতসমৃদ্ধ জেলা সিরাজগঞ্জ। এখানকার তৈরি তাঁতের শাড়ির যেমন সুনাম রয়েছে তেমনি জেলার গামছারও সুনাম রয়েছে। গামছা তৈরি হয় পাঁচলিয়া, নলকা, পাইকশাসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। কাজিপুরের গান্ধাইল নয়াপাড়া, বড়ইতলি, সিরাজগঞ্জ সদরের বেজগাতি, গাড়ুদহ, হরিপুর, দত্তবাড়ি, রতুনি, কালিদাশগাতি। কামারখন্দ উপজেলার পাইকশা, খামার পাইকশা, বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর, শাহজাদপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায়। তৈরি হয় বাহারি রকমের গামছা। তাঁতিদের নিপুণ হাতে তৈরি এসব গামছার গুণগত মান ভালো হওয়ায় চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।
উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের পাঁচিল গামছা তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। এখানে প্রায় প্রতি বাড়িতেই গামছা বুননের দৃশ্য দেখা যাবে। নারীরা সুতায় রং দেওয়া, চরকায় সুতা কাটার পাশাপাশি পুরুষের সঙ্গে সমানতালে তাঁত বোনে। একজন তাঁত শ্রমিক দিনে ৮-১০টি গামছা বুনতে পারে। একথান (৪ পিস) গামছা বুনে শ্রমিকেরা পারিশ্রমিক পায় ১২০ টাকা।
হাটের ব্যবসায়ী হাসেম আলী বলেন, পাঁচলিয়া হাট শত বছরের পুরাতন। কিন্তু গামছা বেচাকেনার জন্য প্রায় ৫০ বছর আগে পাঁচলিয়াতে গড়ে উঠে এই গামছার হাট। মঙ্গলবার ও শুক্রবার সপ্তাহে দুদিন বেচাকেনা চলে এই হাটে। তাঁতিরা গামছার পেটিগুলো মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকে। আর পাইকারদের পছন্দের সঙ্গে দামে মিললেই সেগুলো কিনে নেন তারা। এ হাটে কেনা বেচায় পাইকার এবং তাঁতিদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর। বিশ্বস্ততার সঙ্গে গামছা কেনাবেচা হয়। পুটলি চোরের কোনো উপদ্রুব নেই। ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করেন। পণ্য ও টাকা লেনদেনে কোনো অভিযোগ নেই।
তাঁত মালিক হৃদয় জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এখান থেকে গামছা কিনে বিক্রি করে থাকেন। উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ এই গামছার হাটে বিক্রিও বেশ ভালো। তবে বর্তমানে গামছার বাজারে চরম মন্দাভাব চলছে। অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ক্রমাগত রঙ, সুতাসহ গামছা তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে লোকসানের চাপ ঘিরে ধরেছে তাদের। তাঁত মালিক খন্দকার জাহাঙ্গীর বলেন, অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার কারণে ক্রমাগত রং ও সুতাসহ গামছা তৈরির উপকরণে দাম বৃদ্ধিতে পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁতের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। পাঁচিলা গ্রামের তাঁতি আনছার আলী জানান, তাঁত বুনে যে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় তাতে সংসার চালানো কঠিন। তবুও আমরা এ পেশা ধরে আছি।
পাঁচিলা গ্রামের তাঁতি আজাহার আলী বলেন, তাঁত বুনে যে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় তাতে সংসার চালানো কঠিন। তবুও আমরা এ পেশা ধরে আছি। এটা ছাড়া আমরা বিকল্প কোনো কাজ জানি না। তাই বাধ্য হয়ে এটা ধরেই আছি। একাধিক তাঁতি জানান, দফায় দফায় রং সুতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এ কাজে তেমন একটা লাভবান হতে পারছেন না। কিন্তু বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে কি বা করার আছে। তবে অনেকেই সুযোগ পেয়ে বিকল্প পেশায় চলে গেছেন। আমরা পড়ে আছি সেই তিমিরেই।
বেলকুচির গামছা হাটের পাইকারি মহাজন কামারখন্দের আলম, কাজিপুরের বাবু মিয়া জানান, ২০ বছর ধরে এ হাটে গামছা কিনে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করি। এখন গামছার বাজার একটু ভালো। গত সপ্তাহে প্রতি থান (৪ পিস) ৩৫০ টাকায় কিনেছি। এ সপ্তাহে সেই গামছা ৪০০ টাকা করে কিনছি। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে রং সুতার দামের মনিটরিংসহ ঋণ সহায়তার দরকার।
এদিকে কয়েকজন তাঁতি জানায়, দফায় দফায় রং সুতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এ কাজে তেমন একটা লাভবান হতে পারছেন না।
গামছা কারখানার মালিক সবুর আলী বলেন, গামছা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করে। পাঁচলিয়া হাটে গামছা কেনার জন্য বরিশাল, ঝালকাঠি পিরোজপুর, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকার আসেন। তাদের থাকা-খাবারের জন্য নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন এক সময় গামছা বুনে তারা লাভবান হলেও রং সুতার দাম বৃদ্ধিতে তারা এখন তেমন একটা লাভবান হচ্ছে না। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে রং সুতার দাম কমানোসহ ঋণ সহায়তার প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎপর হওয়া দরকার।
সিরাজগঞ্জ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা অমিত সরকার জানান, সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া হাট গামছার জন্য প্রসিদ্ধ। উত্তরাঞ্চরে সর্ববৃহৎ এই গামছার হাটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন পাইকারি দরে গামছা কেনার জন্য। এখানকার গামছার মান অনেক ভালো। সিরাজগঞ্জের গামছাকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রং ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করবে বোর্ড। উল্লেখ্য, প্রতি হাটে প্রায় ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার গামছা ও সুতা বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন এ হাটের ব্যবসায়ীরা।
পাঁচলিয়া বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী সুমাইয়া ফার্মেসির মালিক কেএম সাজেদুল হক জানান, পাঁচলিয়া বদরুল আলম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবারে গামছার হাট বসে। সকাল ৬টা থেকে হাটে আসেন তাঁতিরা গামছার বড় বড়পোটলা ভ্যান, অটোভ্যান, সিএনজি এমনকি চার চাকার পিকআপ ভর্তি করে গামছা নিয়ে আসেন তাঁতিরা। একই সময় থেকে গামছার পাইকাররাও হাটে আসতে থাকেন। দুপুরের মধ্যেই বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার লোকের সমাগম হয়। শুধু গামছাই নয় হাটে এবং হাটের আশপাশের বিভিন্ন দোকানে পণ্য বিক্রিও বেড়ে যায়। ভাসমান খাবার হোটেলসহ খাদ্যপণ্যের দোকানও বসে প্রচুর। কেনাকাটাও হয় ব্যাপক। পাঁচলিয়া হাটের পাশ দিয়ে অতিবাহিত পাঁচলিয়া-বড়হর-ভুতগাছা সড়ক হাটের মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত যানবাহনের চাপে পথচারীদের যাতায়াতের ভীষণ কষ্ট হয়। তবে সুখের বিষয় পাঁচলিয়া হাট এ অঞ্চলের মানুষের গর্ব।
চেম্বার অব কমার্স
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুর রহমান সিরজগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পাঁচলিয়া হাট নিয়ে জনকণ্ঠকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, যমুনা নদীর পশ্চিমপাড়ের জেলা সিরাজগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এখনো টিকে আছে।
নৌ-পথ, সড়ক পথের এমনকি আকাশ পথেও ব্যবসার সকল সুবিধা সিরাজগঞ্জে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ীরা আশানুরূপ সুবিধা পায়নি। গত ১৫ বছর প্রকৃত ব্যবসায়ীরা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্বে না থাকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা। সিরাজগঞ্জের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে তাঁত কুঞ্জ। সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্পে উৎপাদিত পণ্য দেশজুড়ে সমাদৃত। সিরাজগঞ্জের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছার কদর অনেক বেশি। জেলার বেলকুচি, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুরে শাড়ি এবং লুঙ্গির বিশাল বাজার রয়েছে, সেই সঙ্গে সুতার বাজারও ভালো। উল্লাপাড়ার পাঁচলিয়া এবং কামারখন্দ উপজেলার পাইকশা গামছা বুননের প্রসিদ্ধ স্থান। জেলার বিভিন্ন স্থানে গামছা উৎপাদন হলেও পাঁচলিয়া গামছার বড় মোকাম। প্রায় ৫০ বছর যাবত এই পাঁচলিয়ায় গামছার হাট বসে। দেশের নানা স্থান থেকে পাইকারগণ এ হাটে আসেন। মোকাম করেন। এখানে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁত মালিকদের সুসম্পর্ক রয়েছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই হাটের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। মহাসড়কের পাশে এই হাট, দূর-দূরান্তের পাইকারদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, বর্তমানে ব্যবসায় খুবই মন্দাভাব চলছে। রং, রাসায়নিক দ্রব্য, তাঁত সরঞ্জমাদিসহ সুতার দাম বেশি। উৎপাদন খরচও বেশি। কিন্তু বাজারে ভোক্তার পরিমাণ তুলনামূলক বাড়েনি। রপ্তানিতে বেশি জোর দেওয়ার দাবি জানান এই চেম্বার নেতা।
জীবন জীবিকা
গামছা তৈরি করে জীবন ও জীবিকা চলছে জেলার কয়েক হাজার তাঁতি পরিবারের। সিরাজগঞ্জের সদর, কামারখন্দ, উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের পুরুষ ও নারী কারিগরারা তাঁতে গামছা বুনে। সকাল থেকে রাত অবধি এখানকার গ্রামগুলোতে তাঁতিদের গামছা বুনোনের খট খট শব্দে মুখর থাকে অবিরত। সকাল থেকে রাত অবধি চলে এই গামছা বুনন কাজ। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় তারা নিজ হাতে হরেক রকম সুতায় এ গামছা বোনে। আবার কেউ কেউ শ্রমিক দিয়ে গামছা বোনে। জেলায় কয়েক হাজার তাঁতি এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এর মাধ্যমেই চলে তাদের জীবিকা। প্রতি হাটবারে ব্যসায়ীদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
জানা গেছে, এসব এলাকার তাঁতিদের বোনা গামছা কেনা বেচাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পঁচিলা, বেলকুচি, এনায়েতপুর ও সিরাজগঞ্জ সদরে বৃহৎ গামছার হাট এরমধ্যে সোহাগপুর, সিরাজগঞ্জ, এনায়েতপুর ও পাঁচিলার হাটি সবচেয়ে বড়। ভোর থেকেই দূর-দূরান্তের ক্রেতা বিক্রেতায় সরগম হয়ে ওঠে উল্লেখিত এলাকার গামছা হাট। তাঁতিরা সপ্তাহজুড়ে গামছা বুনে হাট বারে এখানে এনে বিক্রি করে। বাড়ির পাশে হাট খুব সহজেই তাঁতিরা তাদের গামছা বিক্রি করে। এ হাটে কোটি টাকারও বেশি টাকার গামছা বেচাকেনা হয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই হাট। হাটে দূর-দূরান্ত থেকেই তাঁতিরা আসেন। বেচাবিক্রি শেষে নগদ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন নিরাপদে। এ অঞ্চলের মানুষ ব্যবসায়ী, তাই ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার বিষয়ে খুব সজাগ থাকে।
হাটবারের খাদ্যপণ্য কেনাবেচা
শামীম হোসেন পাঁচলিয়া গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। সাপ্তাহিক হাটবারে দিনমজুরি করে সংসার চালায়। তার মতে, হাটবারে মাছ মাংস হাঁস-মুরগির দাম বেড়ে যায়। অন্যান্য দিনের চেয়ে সাধারণত হাটবারে খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলনামূলক দামও বাড়ে। গামছাসহ কাপড় ও সুতা ব্যবসায়ীরা এ দিনে বিশেষ বিশেষ খাত মাছ, মাংস, হাঁস-মুরগি বেশি বেশি কিনে থাকেন। ওইদিন প্রতিজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে অন্যান্য দিনের তুলনায় রান্নার পরিমাণও বেড়ে যায়। কারণ আত্মীয়-স্বজনের আগমন ঘটে। এ কারণে সাধারণ মানুষগুলোর সকালের বাজারে কেনাকাটায় সুযোগ কমে যায়। তবে পণ্য সরবরাহও অন্যান্য দিনের তুলনায় বেড়ে যায়।
যেভাবে তৈরি হয় গামছা
প্রথমে বাজার থেকে সুতা কিনতে হয়। এই সুতা তাঁতির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ ৪০ কাউন্ট, ২০ কাউন্ট। কাউন্ট বলতে বোঝানো হয় সুতার চিকন ও মোটার পরিমাপ। কাউন্ট যত বেশি হবে সুতা তত চিকন হবে। সুতা কিনে গামছার ডিজাইন অনুযায়ী সুতা রঙ করা হয়। রং করে তা রোদে শুকিয়ে হাতে তৈরি চড়কা বা মেশিনে তা পল্লা তৈরি করা হয়। পল্লা থেকে আবার ছিটা বা নলিতে (প্লাস্টিকের তৈরি) তোলা হয়। সেখান থেকে ড্রামে উঠিয়ে আবার সানার ভেতর দিয়ে মোটা নরদে তোলা হয়। এর পর সানা বউ করে তাঁতে তোলা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নারী ও পুরুষ শ্রমিক। প্রতিটি প্রক্রিয়ায় একজন করে শ্রমিক কাজ করেন।
এক সময়ে গামছা তৈরি হতো খটখটি তাঁত দিয়ে। তাঁত বসানো হতো সমতল মাটিতে। তবে তাঁত চালানোর জন্য দুই পা দিয়ে বও টানা হতো। এ জন্য মাটি গর্ত করে খুব সুন্দর খাদ তৈরি করা হয়েছে। এই খাদের নাম দেওয়া হয় ‘বেগি’। দেখতে অনেকটা সামরিক আন্ডার গ্রাউন্ড স্থাপনার মতো। এক হাতে মাকু চালনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মুঠি, অন্য হাতে মাকু চলাচলের জন্য সানার দণ্ড। এ সবই কাঠের তৈরি। মাকু হচ্ছে সুতার বাহক। কিন্তু এখন তাঁত কারখানা আধুনিকতার ছোয়ায় অনেক বদলে গেছে। তাঁত কারখানায় যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ। তাঁত তৈরি হয় লৌহজাত দ্রব্যাদি দিয়ে এবং তা আমদানিনির্ভর।
গামছা তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত সামাজিকভাবে তাদের পরিচিতি হচ্ছে তারা ‘কারিগর’ সম্প্রদায়ের মানুষ। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অনেকেই তাদের ‘জোলা’ বলে থাকেন। সুতায় ‘জো’ তুলে অর্থাৎ সুতায় সুতায় জোড়া দিয়ে যারা মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করেন তারাই জোলা।
তবে এখন কারিগর সম্প্রদায়ের ব্যবসায়িক সাফল্যে কৃষি পরিবারের অনেকেই তাঁত কারখানার মালিক হয়েছেন।
পাঁচলিয়া হাটের ভৌগোলিক
অবস্থান
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিমপারের জেলা সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পশ্চিমে প্রায় ২০ কি.মি. দূরে পাঁচলিয়া গ্রাম। গ্রামটি পাট বন্দরখ্যাত উল্লাপাড়া উপজেলার একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সলঙ্গা থানার অন্তর্গত। নির্বাচনী কাজে হাটিকুমরুল ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্রিটিশবিরোধী সলঙ্গা কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীগের জন্মস্থান তারুটিয়া বা পরিবর্তিত নাম রশীদাবাদ ও আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক সাহিত্য রত্ন খেতাবে ভূষিত নজিবর রহমানের (সাহিত্যরত্ন) জন্মস্থান হাটিকুমরুলের পাশেই এই পাঁচলিয়া গ্রামের অবস্থান। বঙ্গবন্ধু সেতু পেরিয়ে পশ্চিমের মহাসড়ক পথে প্রায় ২৫ কি.মি. পথ পেরুলেই মহাসড়ক সংলগ্ন পাঁচলিয়া হাট। মহাসড়ক সংলগ্ন পাঁচলিয়া সীমানায় যানবাহন চালক এবং যাত্রীদের বিশ্রামাগার (ইন্টারচেঞ্জ) নির্মিত হয়েছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি পেট্রোল পাম্প।
গামছা তৈরির কারিগর
গামছা তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত সামাজিকভাবে তাদের পরিচিতি হচ্ছে তারা ‘কারিগর’ সম্প্রদায়ের মানুষ। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অনেকেই তাদের ‘জোলা’ বলে থাকেন। সুতায় ‘জো’ তুলে অর্থাৎ সুতায় সুতায় জোড়া দিয়ে যারা মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করেন তারাই জোলা। তবে এখন কারিগর সম্প্রদায়ের ব্যবসায়িক সাফল্যে কৃষি পরিবারের অনেকেই তাঁত কারখানার মালিক হয়েছেন। জোলার ব্যবসা করেন।
এক সময়ে গামছা তৈরি হতো খটখটি তাঁত দিয়ে। তাঁত বসানো হতো সমতল মাটিতে। তবে তাঁত চালানোর জন্য দুই পা দিয়ে বও টানা হতো। এ জন্য মাটি গর্ত করে খুব সুন্দর খাদ তৈরি করা হয়েছে। এই খাদের নাম দেওয়া হয় ‘বেগি’। দেখতে অনেকটা সামরিক আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনার মতো। এক হাতে মাকু চালনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মুঠি, অন্য হাতে মাকু চলাচলের জন্য সানার দণ্ড। এ সবই কাঠের তৈরি। মাকু হচ্ছে সুতার বাহক। কিন্তু এখন তাঁত কারখানা আধুনিকতার ছোয়ায় অনেক বদলে গেছে। তাঁত কারখানায় যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ। তাঁত তৈরি হয় লৌহজাত দ্রব্যাদি দিয়ে এবং তা আমদানি নির্ভর।
মোহাম্মদ আলী