অগ্রহায়ণ মাস। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। অতিরিক্ত শীত পড়ার কারণ আচমকা বৃষ্টি। এখন বৃষ্টি হওয়ার কথা না। এ বছর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘুমন্ত মানুষের ওপর কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এ দেশের মানুষদের। বাংলাদেশের মানুষ সেই নৃশংসতা মুখ বুজে সহ্য করেনি। তারা পাল্টা আক্রমণ করেছে। শুরু হয়েছে লড়াই। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ।
আবদুল হান্নান বসে আছে জলডুবি বাজারে হায়াত মুহম্মদের সেলুনের একপাশে পেতে রাখা কাঠের সরু বেঞ্চের ওপর। সে সেলুনে চুল কিংবা দাড়ি কাটাতে আসেনি। সে এসেছে হায়াতের কাছে খবর নিতে। হায়াতের কাছে গোপন খবর থাকে। নানাভাবে খবর জোগাড় করে রাখে। হান্নান বা কোনো মুক্তিযোদ্ধা এলে তাদের গোপন খবর জানিয়ে দেয়।
হান্নান এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। ভারত থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। গ্রামে এসে আগ্রহী ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল বানিয়েছে।
পুরো জলডুবি গ্রাম থমথম করছে। মানুষজনের চলাচল কম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জলডুবি প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করেছিল। গত পরশুদিন সকাল থেকে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির ভেতর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল জলডুবি গ্রামের মানুষ। তাদের কাছে তির, ধনুক, বর্শা আর বল্লম। একসঙ্গে এত মানুষ দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘাবড়ে গেল। তাদের অবস্থা হয়ে গেল দিশেহারা। প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়েছে।
তারপর থেকে গ্রাম থমথম করছে। মানুষজন বলাবলি করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার আসবে। হায়াতের সেলুনে নানারকমের মানুষ আসে। তাদের ভেতর এমন মানুষও আছে যারা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে যাচ্ছে। তারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস আর শান্তিবাহিনী বানিয়েছে। তারাও মাঝেমধ্যে চুলদাড়ি কাটাতে আসে। তখন হায়াত তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে গোপন তথ্য বের করার চেষ্টা করে।
জলডুবি গ্রামের একজন রাজাকারের নাম হচ্ছে কাদের। সে এসে বলল, কী হায়াত মুহম্মদ আছ কেমন?
হায়াত বলল, ভালো থাকি কিভাবে? মুক্তিযোদ্ধারা যা শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে আমাকেও ইন্ডিয়ায় চলে যেতে হবে।
কাদের বলল, তুমি ইন্ডিয়ায় যাবা কেন? তুমি তো হিন্দু না, তুমি সাচ্চা মুসলমান।
হায়াত অভিমানভরা গলায় বলল, মুসলমান হলে কী হবে কাদের ভাই, নাপিত তো! এখন জলডুবি গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। তারা এসে বলবে, নাপিত আবার মুসলমান হয় নাকি? তুই ভেজাল মুসলমান। তুই ফুটুস। গুলি করে দিলেই আমি শেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের ভয়ে পালিয়েছে আর আমি লুঙ্গিছেঁড়া গরিব নাপিত।
কাদের হা হা করে হাসছে। সে হাসি থামিয়ে বলল, পাকিস্তানি আর্মিকে ভীতু মনে করবা না, হায়াত মুহম্মদ। তাদের সাহস অপরিসীম। তারা ফিরে আসবে জলডুবিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাধের জলডুবিকে তছনছ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।
খুশি হওয়ার ভান করে হায়াত বলল, দীলে বড়ো শান্তি পাচ্ছি কাদের ভাই। পাকিস্তানি আর্মিরা কবে আসবে?
কাদের বলল, পাকা খবর। জেলা সদর থেকে পাক মিলিটারি রওনা হয়ে গেছে। আজ রাতে এসে পৌঁছাবে জলডুবি গ্রামে।
হায়াত একজনের চুল কাটছে। তার চুল কাটা শেষ হলে হান্নানকে খবরটা জানাবে- আজ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢুকবে জলডুবি গ্রামে। চুলকাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তখন জমসেদ মাস্টার ঢুকলেন সেলুনে। ঢুকেই বললেন, নুরু নাপিত, তুমি স্কুল যাওয়া বন্ধ করেছ! অতি খারাপ অভ্যাস। নিয়মিত স্কুলে যাবে।
জমসেদ মাস্টার জলডুবি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
হায়াত বলল, নুরু, স্যারের মুখে সাবান ঘষতে থাক। আমি দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছি।
নুরু হচ্ছে হায়াত মুহম্মদের ছেলে। তার নাম নূর মুহম্মদ। ডাক নাম নুরু। বয়স ১২ বছর। সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছিপছিপে একহারা চেহারা। গায়ের রং মিশমিশে কালো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া। তাকালে মনে হয় চোখ থেকে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। সে বাবার সঙ্গে সেলুনে থাকে। তাই সবাই তাকে নুরু নাপিত বলে ডাকে।
জমসেদ মাস্টার চোখ বন্ধ করে আছেন। তার বুকের ওপর গামছা দেওয়া হয়েছে। নুরু একমনে জমসেদ মাস্টারের মুখে ব্রাশ দিয়ে সাবান ডলছে। সাবানে বেশ ফেনা হয়েছে। জমসেদ মাস্টারের মুখ সাবানের ফেনায় ভরে গেছে। তার ঘুম পাচ্ছে। মুখে শীতল ভাব।
হায়াতের চুল কাটা শেষ হয়েছে। সে হান্নানকে সঙ্গে নিয়ে দোকানের পেছনে চলে গেল। হায়াত বলল, পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে জলডুবি গ্রামে আজ রাতে। কাদের এসেছিল সকালে। সে বলে গেল।
হান্নান কিছু বলল না। চিন্তিত মুখে খালের নিচ থেকে ওপরে উঠে এলো। তাকে দেখে দৌড়ে এসেছে নুরু। সে হান্নানের হাত ধরে বলল, আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলেন।
হান্নান শীতল গলায় বলল, তোমার বয়স অল্প। ছোটো ছেলেমেয়েদের যুদ্ধে যেতে নেই।
নুরু বলল, আপনি যদি আমাকে না নিয়ে যান তাহলে আজ রাতে আমি বাড়ি ছাড়ব। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাব সেখানে চলে যাব।
হান্নান অসহায় চোখে তাকাল হায়াতের দিকে। হায়াত বলল, সে যখন যেতে চাইছে নিয়ে যান।
হান্নান রাজি হলো। নুরু লাফাতে লাফাতে হান্নানের সঙ্গে যুদ্ধে চলে গেল।
শীতের রাত। মুক্তিযোদ্ধা দল এগিয়ে আসছে। কমান্ডার হান্নান আছে তাদের সঙ্গে। নুরু প্রথমে গ্রামে ঢুকেছে। সে গেছে গ্রামের অবস্থা দেখতে। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে ঢুকে ওত পেতে আছে আড়ালে। পাকিস্তানি মিলিটারি গ্রামে ঢুকলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করবে।
আশপাশ ভালো করে দেখে নুরু ফিরে এলো।
হান্নান বলল, কী খবর গ্রামের?
নুরু বলল, সব ঠিক আছে। এখন গ্রামে ঢোকা যায়।
মুক্তিযোদ্ধা দল জলডুবি গ্রামে ঢুকে পড়ল।
তারা বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল গ্রামের ভেতর। যেতে যেতে আচমকা নুরু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আপনারা এখানে থাকেন। আমি সামনে থেকে ঘুরে আসছি।
নুরু এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দেখে পাকিস্তানি সৈন্য এসে গ্রাম ভরে গেছে।
দৌড়ে ফিরে এলো নুরু। মুক্তিযোদ্ধা দলকে ঘটনা জানাল।
পাকিস্তানি সেনাদের দেখা গেল রাস্তায়। তারা মার্চ করে জলডুবি গ্রাম দখল করতে এগিয়ে আসছে।
হান্নান বলল, ফায়ার।
অমনি পাকিস্তানি সৈন্যদের দিকে রাইফেল তাক করে গুলি করল মুক্তিযোদ্ধারা।
পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের প্রস্তুত করার সময় পেল না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে মরে গেল। আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে তারা হতভম্ব হয়ে গেছে। ভয় পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা পেছন ফিরে দৌড়ানো শুরু করল। তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার থেমে থেমে গুলি করছে।
দু’পক্ষই গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক চলল প্রচণ্ড গোলাগুলি। তারপর ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দিক থেকে গুলি করার গতি কমে এলো। তাদের গুলি ফুরিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকজন সৈন্য মারা গেছে।
একসময় আর যুদ্ধে টিকে থাকতে পারল না পাকিস্তানি সেনারা। যে কয়েকজন বেঁচে আছে তারা গুলি করতে করতে পেছাতে থাকল। পেছাতে পেছাতে পেছন ফিরে জলডুবি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধা দল যুদ্ধ জয় করে সামনে এগিয়ে চলল। তাদের সঙ্গে চলল কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নূর মুহম্মদ।*
* সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পটি লেখা হয়েছে- লেখক
মোহাম্মদ আলী