সরকারি প্রতিষ্ঠানের নারীরা সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন ভাতাদি পেলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোথাও কোথাও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন তা প্রায়শই চোখে পড়ে। সেটি ভিন্ন ক্ষেত্র। কিন্তু গ্রামীণ জনপদের নারী শ্রমিকরা বরাবরই কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্যের শিকার। কিন্তু কেন হচ্ছেন? কারা এই বিভাজন তৈরি করছেন? নারীর শ্রম যদি পুরুষের শ্রমের সমান হয় তা হলে কেন তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হবেনÑ এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ তারাও সমাজ, দেশের উন্নয়নের অংশীদার। নারীরা শ্রম দেয় অভ্যন্তরীণ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ কাজে, ধান ও চালকল চাতালে, জমিতে ফসল কাটা ও বুনন কাজে, মাটি কাটা, গৃহ কর্মী বা পরিচারিকার কাজসহ তাঁতশিল্পে। এখানে মজুরির বিনিময়ে নারীরা কাজ করেন। পারিবারিক গৃহস্থালি তাদের নিত্য দিনের কাজ। এ ক্ষেত্রে তারা উন্নয়নের অংশীদার হয়েও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনে কর্মক্ষেত্রের মজুরি প্রদানে এ বিভাজন দূর হওয়া দরকার।
কখনো পুরুষ শ্রমিকের সমান, কখনো বা বেশি কাজ করেও তারা মজুরি পাচ্ছেন কম। ঘরের কাজ সেরে জীবিকার জন্য মাঠে নেমেও সমান মর্যাদা পাচ্ছেন না তারা। অনেক ক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে সমান বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের জেলার বিভিন্ন স্থানে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
তারা জানান, মজুরি কম জেনেও জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হচ্ছে। পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করলেও কখনো কখনো পুরুষ সহকর্মী, কখনো মালিক পক্ষের হাতে নিগৃহীত হতে হয়। এমনকি অনেক সময় নারী বলে কাজে নিতেও আপত্তি জানান মালিকরা। কাজের ধরন, সময় অনুসারে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও নারী শ্রমিকরা প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের চেয়েও কম মজুরি পান। একজন পুরুষ শ্রমিক ধানের জমিতে সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ধান কাটলে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি পেলেও নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় ৩৫০-৪০০ টাকা।
বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার কামারগাঁ ইউনিয়নের কৃষক বিজয় কুমার প্রামাণিক, পৌর শহরের গোল্লাপাড়া মহল্লার ধান গবেষক ও কৃষক নূর মোহাম্মদ নারী শ্রমিকদের বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, তানোরে নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়িত মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যা ঠিক নয়। এ নিয়ে গবেষণা সংস্থা বারবিকের সহযোগী কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত কুমার সরকার জানান, অঞ্চল ভেদেও নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করলেও তারা পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি পান না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের এই বৈষম্যের মানসিকতা পরিবর্তন করে নারীর যথার্থ মর্যাদা দিতে হবে।
দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার হাটিয়ারী গ্রামের ঊষা রানী রায় আক্ষেপ করে বলেছেনÑ তোমরা কহেন তো, হামরাগুলো পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করি। কিন্তু মজুরি পাই ৩শ’ টাকা আর পুরুষগুলো পায় ৫শ’ টাকা। হামরা কি ওমারগুলোর থাকি কাজ করি? ওরাও আইসে বিহানে, হামরাগুলোও আসি বিহানে। তা হলে ওরা এত পায় কেন?’
কাহারোল উপজেলায় কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করা অধিকাংশ নারীরই মজুরি নিয়ে ঊষা রানীর মতো এমন আবেগ রয়েছে। উপজেলার মাঠে কাজ করার ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেশি থাকলেও তারা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে শত শত নারী দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন। পুরুষ শ্রমিকরা যেখানে সারাদিন কাজ করে মজুরি পান ৫শ’ টাকা আর মহিলা শ্রমিকরা কাজ করে পান মাত্র ৩শ’ টাকা।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, বেলকুচিসহ যমুনার দুর্গম চরের নারীরাও পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় বেশি কাজ করেন। তার পরও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তার পরও সেটা মেনে নিয়ে জীবিকার তাগিদে কাজ করে যেতে হচ্ছে তাদের। ঘরের কাজ শেষ করে বাইরে শ্রম দেওয়ায় শরিক হচ্ছেন তারা। তারা উন্নয়নেরও অংশীদার
পুরুষের সমান শ্রম দিয়ে যা উপার্জন করে তা দিয়ে স্বামী-সন্তানাদি নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এখন বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম তাতে খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মজুরি প্রদানে এমন বিভাজন দূর হওয়া দরকার। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে এ জন্য মালিক পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আইন করেই সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। নারী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, নারীরা এখন আন্দোলনেও আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা বা অবদান চোখের সামনেই আমরা দেখেছি।
এ থেকেও আমরা গর্ভ করে বলতে পারি, শুধু মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রেই নয় সমাজ, রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন দূর হওয়া একান্তই দরকার।
গ্রামীণ নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
শীর্ষ সংবাদ: