ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নারী শ্রমিক

শ্রম আইনের অধিকার

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্রম আইনের অধিকার

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফল পরিণতি দেশ ও জাতির এক মাঙ্গলিক পরিক্রমা। দীর্ঘ শাসনের হরেক দুর্ভোগ সমাজ ব্যবস্থায় যে ক্রান্তিকাল তা এক অবধারিত বিভাজনের বিষাদঘন পরিবেশ। বৈষম্যের শুরুই হয় নারী-পুরুষের ভিন্নমাত্রার শারীরিক, মানসিক গঠন ছাড়াও পুরো সমাজ কাঠামোর লাগাতার ফারাকের নগ্ন দৃশ্য বলাই যায়। তেমন দুঃসহ ব্যবধান সময়ের নব উন্মাদনে জেগে ওঠাই স্বাভাবিক। সেই পালাক্রমে আন্দোলন, বিদ্রোহ ও সমাজ ব্যবস্থার চিরায়ত সংঘাত। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সমাজ সাম্যবাদী থাকলেও লিঙ্গ বৈষম্যই ছিল ঊষাকালের এক দৃশ্যমান ফারাক। যুগ আর সময়ের অবধারিত যাত্রায় আরও কত বিভেদ। পার্থক্য সমাজকে নগ্নভাবে তাড়িত করেছে তাও ইতিহাসের এক বিদগ্ধ পালাক্রম। নারী-পুরুষের প্রভেদ আজও সময়ের অসহনীয় প্রতিঘাত। সেখানে বিত্ত নির্বিত্তের লড়াই, পেশাগত মর্যাদা আর আভিজাত্যের দাপট সব যেন এক সুতায় গাঁথামালা। আর প্রত্যেক মানুষের শ্রম শক্তি এমন এক দুঃসাহসিক সামাজিক উপাদান যা নাকি নিজের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি দামি। আধুনিক হরেক শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের যথার্থ মজুরি না পাওয়ার দৃশ্য হরেক বিপন্নতায় আলোচিত, বিতর্কিত এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য যথার্থ লড়াইও বটে। যে কোনো কারখানার মালিক তার লভ্যাংশের কিছু অংশ শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে অর্জন করে এমন তথ্য ও তত্ত্ব বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের আলোচনায় দীপ্যমান বলা হয়। একজন শ্রমিকের শ্রমমূল্য ধরা হয় নির্দিষ্ট ব্যক্তির শ্রম বিনিয়োগের ওপর। সেখানে বিভিন্ন পণ্ডিত অভিমত ব্যক্ত করেন শ্রমিক উৎপাদনে যা বিনিয়োগ করে সেটা তার শ্রমশক্তি। তা আবার নাকি শ্রমিকের আবশ্যিক শ্রম আর উদ্ধৃত শ্রমে বিভাজিত। প্রয়োজনীয় শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পায়। আর উদ্ধৃত্ত শ্রম বিনিয়োগ করে মালিকের জন্য বাড়তি আয় তৈরি হয়। যা মালিককে সম্পদের পাহাড় গড়তে নিয়ামক শক্তি। এ তো গেল সার্বিক শ্রমিকের বঞ্চনার করুণ ইতিবৃত্ত। সেখানে যখন নারী-পুরুষ শ্রমিক ব্যবধান করা হয় তা আরও ন্যক্কারজনক। শ্রমের সময়, ধরন এবং কর্মযোগে কোনো বিন্দুমাত্র পার্থক্য থাকে না। সেই মাথায় পাথর, বালি, ইট সবই নারী শ্রমিকদের বহন করতে দেখা যায়। শুধু কি তা-ই? একজন নারী শ্রমিককে তার পারিবারিক দায়-দায়িত্ব পালন করে কারখানায় ছুটতে হয়। কাকডাকা ভোরে উঠে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গৃহস্থালি আর প্রাতিষ্ঠানিক দায়-দায়িত্ব অত সহজ ব্যাপার নয় কিন্তু। আর সন্তানের বাড়তি পরিচর্যাও মাকেই সামলানো যুগ ও সময়ের নিতান্ত অপরিহার্যতা। সেখানে পুরুষ শ্রমিক সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা, সকালের নাশতা খেয়ে সবই নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে কর্মস্থলে যাওয়া তাও সমাজ সংস্কারের চিরায়ত বিধি। তার ব্যত্যয় দৃশ্যমান হওয়া বিপরীত আবহের উল্টো চিত্র। উল্লেখ্য, নিরক্ষর, নিম্নবিত্তের অতি সাধারণ নারীদের চিত্রই আলোচ্য বিষয়। আমাদের দেশে পোশাক শিল্পের যে কারখানা সেখানে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। কিন্তু শ্রম মজুরি আইনে তাদের জন্য নাকি আলাদা কোনো বিধিনিষেধ তো নেই-ই। বরং চলমান আইনকেও তোয়াক্কা করছে না মালিক পক্ষ। শ্রম আইনে সেভাবে মজুরি বিভেদ উল্লেখ নেই। সেখানে মালিক পক্ষই নারী শ্রমিকের বাকি মজুরি নিজেদের লভ্যাংশে নিয়ে যায় বলে বিভিন্ন বাদ-প্রতিবাদে মুখর হয়েছে শ্রমিকরা।
বর্তমানে পোশাক শিল্প-কারখানায় নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমে  যাওয়ার চিত্র মোটেও স্বস্তিকর নয়। সেখানে সামনে  এসে  যাচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহারে নারীদের অদক্ষই নয় অনীহাও একটা বড় কারণ।
শিল্প প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কারখানায় নিযুক্ত নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়া কাক্সিক্ষত নয়। বলা হচ্ছে প্রচলিত আইনের সংস্কার করে নারী শ্রমিকের জন্য নতুন আইন বিধি অধিভুক্ত করণ পরিস্থিতির ন্যায্যতা। হরেক বিভেদ যখন সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বাঞ্ছনীয় সেখানে বৈষম্যবিলোপ নারী-পুরুষ শ্রমিকের সমতা বাস্তবায়নও নতুন সময়ের আধুনিকতার বরমাল্য। তবে কারখানায় কর্তব্যরত নারী শ্রমিক ছাড়াও গৃহকর্মী শ্রমিকদের বিবেচনায় আনা হচ্ছে। গৃহকর্মী সুরক্ষা কিংবা অধিকার আইন সেভাবে দৃশ্যমান নয়। পারিবারিক আবহে ভোর থেকে রাত অবধি শ্রম বিনিয়োগ করে নারী গৃহকর্মীরা তাদের দায়-দায়িত্ব পালন করে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পৃথক আইন নিতান্ত দায়বদ্ধতা। সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরে হয় ঠিকা বুয়া নতুবা কিশোরী গৃহকর্মী দিন-রাত কাজ করে মালিকের প্রতি দায়বদ্ধতা পালনে ব্যস্ত থাকে। রাস্তায় নেমে এসে গৃহকর্মীরাও তাদের অধিকার আদায় এবং স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নেরও দাবি তুলে সভা- সমাবেশ করেছে। রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জোটবদ্ধ হয়ে সমস্বরে আওয়াজ তুলল তাদের জন্য অধিকার ও আইনি সুরক্ষাকে আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থার জোরালো আবেদন জানায়। আয়োজনে ছিল কর্মজীবী নারী ও জাতীয় গৃহকর্মী ফোরাম। অবধারিত ও সুচিন্তিতভাবে উঠে আসে শুধু আইনি বিধান নয় তার চেয়ে অত্যাচার, নিপীড়নের যথার্থ সুরাহাও ন্যায্যতার ভিত্তিতে যেন হয়। এমন প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে গৃহকর্মের পেশাকে সমাজ এখনো সেভাবে মর্যাদা কিংবা মূল্যায়নই করে না। যেহেতু গৃহকর্ম কোন সম্মানজনক সামাজিক পেশা নয় সঙ্গত কারণে তারা শ্রম আইনের অধিভুক্ত থাকে না। ফলে তারা মানবেতর জীবনযাপন অধিকার ও স্বাধীনতাহীনতাকে মেনে নিয়ে কাজ করে। 

মোহাম্মদ আলী

×