দেশে নারী শিক্ষার হার বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে নারীদের অনন্য অভিগমন গত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই দৃষ্টিনন্দনভাবে দৃশ্যমান। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রবেশ তাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। বর্তমানে সেখানে এসেছে সময়ের জোয়ার। বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ জোর কদমে এগিয়ে যাওয়ার চিত্র চমকপ্রদ। সেখানে উচ্চ শিক্ষার পরবর্তী কার্যক্রম প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনা আবশ্যিক এক নারী শিক্ষায় গতিময়তা।
বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রসঙ্গটি সত্যিই অনন্য সাধনা। কারণ সবার আগে প্রত্যেকের নজর থাকে উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগটা পাওয়া। তার আগে বসতে হয় ভর্তি পরীক্ষায়। ভর্তি তো নয় যেন যুদ্ধ। মেধা ও মনন যোগ্যতার দেশের কৃতী শিক্ষার্থীদের যে প্রবল প্রতিযোগিতা তা শুধু শিক্ষার্থী নয় সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের জন্যও নাভিশ^াস। নারী শিক্ষার ক্রমপ্রসারমান সুবর্ণ সময়ে ছাত্রীদের ওপর বর্তায় এমন অতি প্রয়োজনীয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়াও। বিশেষ করে ছাত্রীদের সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় সঙ্গে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির যে প্রবল তাড়না সেখানে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর প্রবেশের সুযোগ পাওয়া অনন্য কৃতিত্ব। তেমন সুবর্ণ সময় যখন হাতছানি দেয় তখন ছাত্রীদের পরম পাওয়ার বিষয়টি উজ্জ্বল থেকে আলোকের ঝর্ণাধারায় দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। বিশ^বিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর প্রাসঙ্গিক আরও অধ্যায় সামনে হাজির হয় আগত শিক্ষা জীবনের সামনে। সারাদেশের সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া ছাত্রীরা অনেকে আবাসিক হলে থেকে তাদের উচ্চ শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। বিভ্রাট-বিপত্তির শুরু যেখান থেকে এমনিতে শিক্ষার্থীর তুলনায় হল সংখ্যা অপ্রতুল। শেষ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয় বিশ^বিদ্যালয়ের আশপাশেই স্বল্প টাকায় বাড়ি ভাড়া করে শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেওয়া ছাত্রী সংখ্যা আজ আর হাতেগোনার অবস্থায় নেই। কিন্তু সমস্যা যে গভীরে সেই তিমিরে। কারণ বৈষম্যপীড়িত সমাজ আজও সমতার যথার্থ আলো দেখাতে কেমন যেন পিছু হটছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে আবাসিক হলের সুবিধা বঞ্চিত শতকরা হিসেবে অর্ধশতকেরও বেশি ছাত্রী। তবে নিরাপত্তার অভাবও কম বিড়ম্বনার বিষয় নয়। তার পরও যে সংখ্যক ছাত্রী আবাসিক হলে থাকেন সেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা হতেও বঞ্চিত হওয়ার ইতিবৃত্ত নতুন কিছু নয়। দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২ লাখের ওপর। ছাত্রী ১ লাখ সাড়ে নয় হাজার। ৯৭টি আবাসিক হলের সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ৫০ হাজার ছাত্রী। আবার অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রীর আবাসিক সুবিধা নেই বলে জানা যায়। বিশে^র উন্নত সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ আবাসিক হলের সুবিধা বিদ্যমান। যার কারণে কোনো এক সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডই বলা হতো। কারণ শুরুতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ব্যবস্থা ছিল শতভাগ। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়াও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সঙ্গত কারণে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আবাসিকের ব্যবস্থাপনায় চরম ঘাটতিও পরিস্থিতির বিপন্নতা। প্রতিটি প্রাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা। এমনকি এখন প্রান্তিক এলাকার অনেক শিক্ষার্থী মেধা ও মনন যোগ্যতায় পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়াও দেশের উচ্চ শিক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক। সেখানে ছাত্রী সংখ্যাও বাড়তির দিকে।
তবে প্রতি বছর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার সংখ্যায় ছাত্রীরা এগিয়ে থাকাও নারীদের উচ্চ শিক্ষায় দৃষ্টিনন্দন অনুপ্রবেশ। কিন্তু ছাত্রদের তুলনায় হলের সংখ্যায় ছাত্রীরা বেশ পিছিয়েই। ৬২ শতাংশ ছাত্রীর বিপরীতে ৩৮% ছাত্রের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া নারীদের উচ্চ শিক্ষায় অনন্য যাত্রাপথ। যে সব ছাত্রী হলে জায়গা পায় না তাদের পাশর্^বর্তী মেস ছাড়া গত্যন্তরও থাকে না। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি যা তা যেমন স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে একইভাবে শিক্ষা কার্যক্রমেও ঘাটতি লক্ষণীয়। আর প্রতিদিনের তিন বেলা আহারের সংযোগ। সেখানেও যে কত বিপত্তি বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় সংশ্লিষ্ট আবাসিক হলের ছাত্রীরাই মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করেন। তবে বিষয়ভিত্তিক কিছু বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসিক হলে বসবাস সংখ্যার দিক থেকে প্রত্যেকেরই। দেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে এমন সুযোগ-সুবিধা নজরকাড়া এবং সহনীয় এক চিত্র। তবে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে আসলে কোনো আবাসিক হলই নেই। সেখানে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়ে ছাত্রীরা। আশপাশের স্বল্প জায়গায় ছাত্রদের কোনোমতে মেসে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো বাড়িতে ঠাঁই নিতে হয়। আর ছাত্রীদের যে বেহাল অবস্থা তা বর্ণনার অতীত। থাকা-খাওয়ার জন্য চারপাশের বাড়িতে টিউশনি জোগাড় করে খরচ চালানোও আর এক বিপন্নতার আকাল। সম্প্রতি তারা এমন বৈষম্যমূলক আবাসিক হলের অব্যবস্থাপনায় আন্দোলনে নেমে প্রাসঙ্গিক দাবিতে রাজপথ মুখরিত করে। ছাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। ঢাকা শহরের মধ্যে যারা থাকেন তারা কোনোমতে বাসা থেকে এসে শ্রেণিপাঠে অংশ নেন। যেসব ছাত্রী দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকে আসা তাদের নিত্য দুর্ভোগ পোহাতে সময়ক্ষেপণ হয় অনেক বেশি। ক্লাস, পড়াশোনার বিষয়ে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
মোহাম্মদ আলী