কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রিক্তা আকতার বানু লুৎফাকে বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জাগানো এবং প্রভাবশালী ১০০জন নারীর তালিকায় স্থান দিয়েছে বিবিসি বাংলা বিভাগ। ৩ ডিসেম্বর এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের একমাত্র নারী তিনি পেশায় নার্স এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সারাদেশে প্রশংসিত হয়েছেন। জলবায়ুকর্মী, সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া, রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি এবং বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি এই পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ১০০জন নারীকে তালিকায় বেছে নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে স্থান পেয়েছেন রিক্তা আক্তার বানু। বিবিসির এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এমন সব নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে, যারা তাদের কঠিন পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স রিক্তা আকতার বানু লুৎফা। তার বাড়ি রমনা ইউনিয়নের সরকার পাড়া গ্রামে। স্বামী আবু তারিক আলমসহ এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার তাদের।
দুর্গম এ অঞ্চলে এই নারীর বসবাস। এখানে রয়েছে ১৬টি নদ-নদী আর ৪০৫টি চর-দ্বীপচর। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়। রিক্তা আক্তার বানুর মেয়ে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। দেড় দশক আগে তার এই মেয়েকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অটিস্টিক বলে মেয়েটিকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই থেকে বুকের ভিতর অনেক যন্ত্রণা হতো তার। সেই যন্ত্রণা থেকে আজ আমার এই প্রতিষ্ঠান। আমার মেয়ের কারণে বিশ্বে প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আমাকে স্থান দিয়ে সম্মানিত করেছে। ২০০৯ সালে রিক্তা নিজের জমি বিক্রি করে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি স্কুলে এখন প্রায় ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। স্কুলটি প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। স্কুলটিতে বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় শেখানো হচ্ছে।
‘রি ক্তা আক্তার বানু লুৎফা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’-এর প্রধান শিক্ষক শাহিন শাহ জানান বিশে^র ১০০ জন প্রভাবশালী মহিলার মধ্যে একজন হলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রিক্তা আখতার বানু। তিনি চাকরির পাশাপাশি নিজের জমির ওপর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন ৩০০ প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি।
অভিভাবক শাহআলম জানান, আমার সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ায় একসময় কিছু বলতে ও শুনতে পারতো না। বাড়িতে খুব যন্ত্রণা করতো। গ্রামবাসীর পরামর্শে সন্তানটিকে এই স্কুলে নিয়ে এসে ভর্তি করে দেই। সে কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করার পর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখন একটু একটু কথা বলতে পারে। প্রতিবেশী মো. সোহেল জানান, রিক্তা আক্তার বানু একজন সিনিয়র নার্স। তিনি প্রতিবন্ধীদের সেবায় নিয়োজিত। তিনি চিলমারীর গর্ব। তিনি শুধু জেলার গর্ব নয়। এখন বাংলাদেশের গর্ব।
রিক্তা জানান, এই বিদ্যালয়টি কেন প্রতিষ্ঠা করলাম তার পেছনে অনেক কষ্ট আছে। আমার মেয়েকে যখন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে আসি স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার মেয়েকে বের করে দিয়েছিল। প্রতিবন্ধী বলে তাকে গালিগালাজও করেছিল। তাকে কোথাও ভর্তি করাতে পারিনি। সেই যন্ত্রণা থেকে আজ আমার এই প্রতিষ্ঠান। আমার মেয়ের কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আমাকে স্থান দিয়ে বিবিসি বাংলা বিভাগ যে সম্মানিত করেছে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি খুশিতে আপ্লুত। এই কৃতিত্ব আমার একার নয় সকলের। আমি মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেব আগামীতে। চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, রিক্তা আক্তার বানু খবর শুনে আমার খুব ভালো লেগেছে।
আমরা যখন আমাদের উপজেলাবাসীদের সঙ্গে কথা বলছি তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। এটি বাংলাদেশের জন্য যেমন গর্বের তেমনি চিলমারীবাসীর জন্য গর্বের বিষয়।
মোহাম্মদ আলী