ছবি: সংগৃহীত
সিরিয়ায় দীর্ঘ ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে পারলেও, এবার মাত্র ১২ দিনে পতন ঘটল বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের। গেল ২৭ নভেম্বর আলেপ্পোতে প্রবেশের পর অপ্রতিরোধ্য গতিতে সিরিয়ার একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিতে থাকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম।আচমকা হামলা শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় পতন ঘটলো আসাদ সরকারের।
সিরিয়ার দামেস্কসহ এর আশপাশের অঞ্চল নিয়ে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা ইতোমধ্যেই সত্যি হয়ে ধরা দিচ্ছে।
বিভিন্ন হাদিসে এ অঞ্চলকে মুসলিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া মাহদি (আ.)-এর অনুসরণ, দাজ্জালের আগমন ও হত্যা, ঈসা (আ.) এর আবির্ভাব, শাসনকালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।
‘মুলকে শাম’ বা শাম ভূখণ্ড নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় তার বরকত ও পবিত্রতার বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাসের অগণিত ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে জড়িত। মক্কা-মদিনার পরই যার মর্যাদা স্বীকৃত।
ভৌগোলিকভাবে আগের শাম অঞ্চল বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিস্তৃত রয়েছে। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কিয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শামের ব্যাপারে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার কারণে শাম অঞ্চল অর্থাৎ সিরিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূখন্ড। কিয়ামত পূর্ব কিছু ঘটনাও এই অঞ্চলের সাথে জড়িত। এখানে ইমাম মাহদির হাতে বাইয়াত, ইসা (আ.) এর আগমন, দাজ্জালের হত্যাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।
হজরত শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানকালে তাকে শামবাসীর ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন। তখন তিনি বলেন, না, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল) থাকেন।তারা ৪০ জন থাকেন। যখনই তাদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহ তার স্থানে অন্য একজনকে রাখেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় ও শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাদের অছিলায় শামবাসীর ওপর থেকে আজাব তুলে নেওয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৯৬)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোত্কৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরত ভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে। আর পুরো পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষরাই বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফিতনার আগুন তাদের বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে সেখানেই ফিতনা লেগে থাকবে)। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮২)
ইবনে হাওয়ালা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলামী বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সে যুগ পাই, তখন আমি কোন দলে যুক্ত হব, তা বলে দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে। কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি। সেখানে তিনি তার সর্বোত্কৃষ্ট বান্দাদের একত্রিত করবেন। আর যদি তুমি তাতে যুক্ত না হতে পারলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো। আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮৩)
আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উত্কৃষ্ট শহরগুলোর একটি।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৯৮)
আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘খোরাসান ভূমি থেকে কালো পতাকাবাহী দল বের হবে। তাদের কোনো কিছুই প্রতিরোধ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তারা তা ‘ইলিয়া’ তথা জেরুজালেমে না পৌঁছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৬৯)
উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীর একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসীর অনেক লোক তার কাছে আসবে এবং তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাম থেকে একটি (বাতিল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছালে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। মানুষ তা দেখার পর শামের আবদালরা ও ইরাকবাসী উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। অতঃপর কুরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে। কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবেলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালব থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিতে উপস্থিত হবে না তাদের জন্য আফসোস। মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন ও নবী করিম (সা.)-এর সুন্নাত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্য পরিচালনা করবেন। আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তার জানাজার সালাত পড়বে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, কেউ কেউ হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান।
নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’
দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী করিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে সে মারা যাবে। আর তাঁর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭)
শিহাব