ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

একাত্তরের সেই উদ্যোগ স্মরণীয় হয়ে আছে আজও

বাঙালির পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে যেভাবে কাজ করেছিল ডাকটিকিট

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২১:২৯, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাঙালির পক্ষে বিশ্ব জনমত  গঠনে যেভাবে কাজ  করেছিল ডাকটিকিট

লন্ডনের হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট হাতে বিমান মল্লিক, বিচারপতি আবু সাঈদ ও জন স্টোনহাউস

মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই একসঙ্গে ৮টি ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কাভার প্রকাশ করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারমুজিবনগর, কলকাতা ও যুক্তরাজ্য থেকে একযোগে প্রকাশিত ডাকটিকিট আজ ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে আছেবিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ, বাঙালির স্বপ্ন ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে এবং জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল ডাকটিকিটগুলো। 

দেশ যখন আক্রান্ত, মানুষ যখন গৃহহারা তখন এমন একটি সফল উদ্যোগ কি করে সম্ভব হলো? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই সামনে আসে এক বিদেশী বন্ধুর নামজন স্টোনহাউস নামের এই সুহৃদ যুক্তরাজ্যের নাগরিকব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন তিনিদায়িত্ব পালন করেছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবেওমূলত তার এই অভিজ্ঞতাটি বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রকাশের কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলডাক বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনিডাকটিকিটে কী কী বিষয় তুলে ধরা হবে তা ঠিক করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারসে অনুযায়ী শুরু হয় ডাকটিকিটের জন্য ডিজাইনার খোঁজার কাজজন স্টোনহাউসের জন্য কাজটা সহজই ছিলতখন ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় ডাকটিকিটের নক্সা করে বেশ নাম কুড়িয়েছেন ভারতের শিল্পী বিমান মল্লিকমহাত্মা গান্ধীর ছবি সংবলিত ডাকটিকিটের নক্সা করেছিলেন তিনিএ কাজটি করার সময় স্টোনহাউসের সঙ্গে পরিচয় হয়পরিচয় সূত্রেই বাংলাদেশের  ডাকটিকিটের নক্সা করে দেওয়ার প্রস্তাব পান

বিমান মল্লিকের এক সাক্ষাকার থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল জন স্টোনহাউস তাকে ফোন করে ডাকটিকিটের নক্সা করার প্রস্তাব দেনবলেন, বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট করে দিতে হবেসময় খুব কমবাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পারাকে গর্বের মনে করে মুহূর্তেই রাজি হয়ে যান মল্লিককাজ এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ৩ মে উভয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় হাউস অব কমন্সেপরের বৈঠকে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে যোগ দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীআলোচনা অনুযায়ী, বিমান মল্লিক নক্সার কাজ শুরু করে দেনটানা ছয় সপ্তাহ কাজ করেন তিনিট্রেনে যাতায়াতের সময় নক্সার কাজ করতেনখাবার টেবিলে বসে করতেন নক্সার কাজকলেজে পড়াশোনা ফাঁকি দিয়েও করতেন নক্সার কাজসাক্ষাকারে তিনি জানিয়েছেন, টিকিটের গায়ে কী তথ্য থাকবে, কোন কোন প্রতীক বা ছবি ব্যবহৃত হবে সে সম্পর্কে তাকে খুব বেশি ধারণা দেওয়া হয়নিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নক্সার কাজ শেষ করতে হয়েছিল তাকে

ডাকটিকিটের কাজের সঙ্গে পরে যুক্ত হন আরেক ব্রিটিশ বন্ধু দাতব্য প্রতিষ্ঠান ওয়ার অন ওয়ান্টপ্রধান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থতিনি কলকাতায় গিয়ে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে মূল নক্সার অনুমোদন নিয়ে আসেনএরপর শুরু হয় ছাপার কাজছাপার কাজ করা হয় যুক্তরাজ্যের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টং প্রেসে২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়এতে উপস্থিত থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকিট ও ফার্স্ট ডে কাভার প্রদর্শন করেনযুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমে খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়

৮টি ডাকটিকিটের মূল্য ধরা হয় এক পাউন্ড নয় পেনিবাংলাদেশের ১০ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মানচিত্রএটি দেখিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ববাসীর সমর্থন চাওয়া হয়টিকিটের গায়ে ইংরেজিতে লেখা ছিল সাপোর্ট বাংলাদেশবাংলাদেশ বলেই অনিবার্য হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি স্থান পায় ৫ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটেশৌর্য বীর্যের সবটুকু নিয়ে দৃশ্যমান হন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক৩ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে ছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার গঠনের খবরটিএর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়৭০ এর নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি আওয়ামী লীগবাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানিরা২ টাকা মূল্যমানের টিকিট সেই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেপৃথিবীর সব দেশকে জানিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামএই সংগ্রাম অনিবার্য ছিলনতুন রাষ্ট্রকে চেনাতে জাতীয় পতাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে১ টাকা মূল্যমানের টিকিটের গায়ে ছিল বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকামানচিত্র খচিত পতাকা স্থান পায় এই টিকিটে৫০ পয়সা মূল্যমানের টিকিটে খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশে সাড়ে ৭  কোটি মানুষের তথ্য২০ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটে ছিল ২৫ মার্চের কালোরাত্রির ইতিহাসঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার প্রতীকী প্রকাশ ঘটানো হয় রক্তের ফোটা এঁকে দিয়ে১০ পয়সা মূল্যমানের টিকিটে দেখানো হয় বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাএভাবে  মোট ৮ টিকিটে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ

টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সি২৯ জুলাই উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের ডাকটিকিটপৌঁছে যায় বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলেওপ্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া ফেলে যুদ্ধ দিনের ডাকটিকিটকতটা সাড়া ফেলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানিদের আচরণেযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানিরা ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে হাজির হয় অভিযোগ নিয়েপাকিদের দাবি ছিল, এসব টিকিটের আইনি ভিত্তি নেইএগুলো অবৈধকিন্তু ততদিনে ডাক ডিকিটগুলোর মূল বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে গেছে বিশ্ববাসীর কাছেফলে অভিযোগে কোনো কাজ হয়নিবরং বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে ডাকটিকিটগুলো

×